প্রাসঙ্গিক ভাবনা / ড. মোঃ নূরুল আমিন
ফাঁসির রায় ও মুজাহিদের আক্ষেপ
গত ১৬ জুন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিল মামলার রায় প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে জনাব মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। জনাব মুজাহিদ ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই দিন তার চূড়ান্ত রায়ে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
আপিল বিভাগের রায়ে জনাব মুজাহিদকে একটি হত্যা মামলা থেকে খালাস এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও সহযোগিতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
রায়ের পরপর জনাব মুজাহিদের আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন যে, ঢালাও অভিযোগে জনাব মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এদিকে কারাগারে আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাৎকালে জনাব মুজাহিদ নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, কাকে কোথায় কখন, কীভাবে হত্যার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালত তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন তা তার বোধগম্য নয়।
জনাব মুজাহিদ নগণ্য কোনও ব্যক্তি নন; এই দেশের ইসলামী আন্দোলন ও অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের মহাসচিব। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রিত্বকালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দল প্রীতি অথবা ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনও অভিযোগ উঠেনি এবং এমনকি মন্ত্রিত্বের পরও সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার থেকে শুরু করে প্রতিহিংসাপরায়ণ আওয়ামী লীগ সরকার পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার অথবা তার মন্ত্রণালয়ে সংঘটিত কোনও অনিয়ম তালাশ করে পায়নি। সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে তিনি মন্ত্রিত্ব করেছেন, সর্বদা দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার মতো স্বনামধন্য একজন ব্যক্তিকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী হিসেবে কি অপরাধে, কাকে, কখন, কিভাবে হত্যার অভিযোগে ফাঁসির মতো দণ্ড তিনি পেয়েছেন তা জানার তার অধিকার রয়েছে। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি তা জানেন না। তার এই আক্ষেপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যে মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য আমরা উদগ্রীব তার স্বার্থে এই বিষয়টির সুরাহ হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
জনাব মুজাহিদের মৃত্যুদ- নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তিত্ব তাদের মতামত ও উদ্বেগ পেশ করেছেন। খ্যাতনামা বৃটিশ আইনজীবী ও পার্লামেন্টারিয়ান এবং মানবাধিকার প্রবক্তা লর্ড কার্লাইল এই বিচারকে ন্যায়ভ্রষ্ট ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিচারের মান, সাক্ষীদের সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা, আদালতের কথিত বৈষম্যমূলক আচরণ, বিচারকদের নিরপেক্ষতা প্রভৃতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এবং বলেছেন যে, যে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে জনাব মুজাহিদকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে তা নিম্নমানের এবং তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই।
ব্রাসেলস ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা নো পিস উইদাউট জাস্টিস (ঘচডঔ) নন ভায়েলেন্ট রেডিক্যাল পার্টি ও এনআরপিটিটি এই রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে রোম সংবিধি অনুযায়ী ভিক্টিমের সঠিক বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। সংস্থার আইন উপদেষ্টা এলিসন স্মীথ কর্তৃক প্রদত্ত এই বিবৃতিতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া ও ন্যায্যবিচার নিশ্চিত না করায় তাদের অব্যাহত উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয় ইতঃপূর্বে এই ট্রাইব্যুনাল যেসব রায় দিয়েছিল তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল যথেষ্ট উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল, কেননা যে প্রক্রিয়ায় সেখানে বিচার কাজ চলেছে তাতে অভিযুক্তের ন্যায়বিচার পাওয়ার ন্যায্য অধিকার বারবারই লঙ্ঘিত হয়েছে। তাদের মতে মুজাহিদের মৃত্যুদ-ের রায়টি হচ্ছে সেই ভ্রান্ত বিচার প্রক্রিয়া ও অন্যায্য রায়ের সর্বশেষ উদাহরণ। বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগের পেছনে আরও যেসব কারণ ছিল তার মধ্যে রয়েছে আইসিটির বিচারকদের আইনের মূলনীতিসমূহ প্রয়োগে ব্যর্থতা, আসামী পক্ষের সাক্ষীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে সীমিত করে দেয়া প্রভৃতি। বিবৃতিতে বলা হয় যে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়ে অভিযোগের তদন্ত করা হয়েছে এবং তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। এতে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ড স্থগিত করে বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত রোম সংবিধি অনুযায়ী অভিযুক্তদের জন্য সঠিক বিচার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানানো হয়।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠনসমূহ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের প্রয়োগ ও মান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে তাকে গ্রহণযোগ্য মানে উন্নীত করার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ পেশ করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তার কোনটিই গ্রহণ করেননি। অভিযুক্তদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফৌজদারী আইন ও সাক্ষ্য আইনের কার্যকারিতা স্থগিত রাখা ছাড়াও তাদের বেলায় সংবিধান প্রদত্ত মানবাধিকারসমূহও বাতিল করে রাখা হয়। ফলে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবার একটি ধারণা তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় এবং বাস্তবে তার প্রতিফলনও ঘটে। এ প্রেক্ষিতে এনপিডব্লিউজে'র দাবি অনুযায়ী রোম সংবিধি অনুযায়ী ভিকটিমদের সঠিক বিচার নিশ্চিত করার আহ্বানের যৌক্তিকতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এখন বুদ্ধিজীবী হত্যা ও তার সাথে জনাব মুজাহিদের সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু বলা জরুরি বলে আমি মনে করি।
এই স্তম্ভে আমি বহুবার বলেছি যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার মানবিক বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এর গভীরে গিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা না করে ঢালাও দোষারোপের মাধ্যমে তারা জাতির একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে বিভ্রান্ত করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ও আচরণে তারা কখনো অকৃত্রিম ও আন্তরিক ছিলেন না। তারা আজ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় রয়েছেন। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও তারা নিহত বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করতে পারেননি। ১৯৭২ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রকাশনায় ২২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ৫৯ কলেজ শিক্ষক, ২৭০ জন মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক, ৬৩৯ জন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, ১৩ জন সাংবাদিক, ৫০ জন ডাক্তার এবং অন্যান্য পেশার ১৭ জন মিলিয়ে ১০৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এই তথ্য সূত্রের ভিত্তিতে ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ সংগ্রহের চেষ্টা করে। কিন্তু তা কখনো পাওয়া যায়নি। ঐ বছরই ১৪ জন বুদ্ধিজীবীর স্মৃতির একটি প্রদর্শনী হয়। ১৯৮৫ সালে একাডেমির তরফ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিকোষ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় এবং এতে ২৫০ জনের অনেকেরই আবাসিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর ১০ খন্ডে তারা স্মৃতি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যাতে ২৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় স্থান পায়। এই ২৩৮ জনের বাইরে একাডেমি আর কোনও তালিকা সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ একাধিকবার ক্ষমতায় গিয়েও এই অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করেনি। তাদের প্রথম মেয়াদে বুদ্ধিজীবী হত্যার রহস্য উন্মোচনের জন্য জহির রায়হানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। জানা যায় যে, উক্ত কমিটি অপরাধীদের চিহ্নিত করে অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণও সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু সংগৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণ আওয়ামী লীগের অনুকূলে ছিল না। ফলে তদন্তের ফলাফল রসাতলেই শুধু যায়নি জহির রায়হান তথ্য-প্রমাণসহ অপহৃত হয়ে নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতেও বাধ্য হয়েছেন। বলাবাহুল্য, ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জহির রায়হান ঘোষণা করেন যে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পেছনের নীলনকশা উদ্ঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র প্রামাণ্য দলিল তার কাছে আছে যা প্রকাশ করলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নেয়া অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে। তিনি ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবে এ সংক্রান্ত একটি ফিল্ম শো প্রদর্শনেরও ঘোষণা দেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ৩০ জানুয়ারি সকালেই তার কায়েতটুলির বাসায় একটি টেলিফোন আসে যাতে বলা হয় তার বড় ভাই (নিখোঁজ) শহীদুল্লাহ কায়সার মীরপুর ১২নং সেকশনে আছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি সকালেই ভারতীয় বাহিনীর এক মেজরের সাথে মীরপুর যান। জহির রায়হান আর বাসায় ফিরে আসেননি। তার এই অন্তর্ধানকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু লেখালেখি হয়েছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। দৈনিক আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর '৯৩ সংখ্যায় "জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়" শিরোনামে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। এতে জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ একজন নেতার কথিত মন্তব্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। জহিরের নিখোঁজ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হবার পর ঐ নেতা নাকি জহিরের বড় বোন নাফিসা কবিরকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, "জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এরকম চীৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে।" জহির বড় ভাই-এর সন্ধানে গিয়ে নিখোঁজ হন এবং প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যা সংক্রান্ত যে তথ্যপ্রমাণ তার কাছে ছিল এবং তিনি ৩০ জানুয়ারি যা প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা যাতে করতে না পারেন তার জন্যেই তাকে অপহরণ করে রফিক নামে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেছিল। পত্র-পত্রিকায় এই তথ্যও প্রকাশিত হয়েছিল। এই রফিকের রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামী লীগ প্রকাশ করেনি এবং জহির হত্যার বিচারও করেনি। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রকৃত রহস্য এখানেই নিহিত। এই রহস্যের কূল-কিনারা না করে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর দোষ চাপিয়ে তাদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করছে বলে দেশবাসী মনে করেন। এমতাবস্থায় জনাব মুজাহিদের পক্ষে আক্ষেপ করা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তিনি ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন। কেন পেয়েছেন তিনি যেমন জানেন না, যারা দণ্ড দিয়েছেন তারাও সম্ভবত জানেন না। এমতাবস্থায় ইনসাফের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে গঠিত একটি নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আপিল বিভাগের রায়ে জনাব মুজাহিদকে একটি হত্যা মামলা থেকে খালাস এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও সহযোগিতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
রায়ের পরপর জনাব মুজাহিদের আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন যে, ঢালাও অভিযোগে জনাব মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এদিকে কারাগারে আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাৎকালে জনাব মুজাহিদ নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, কাকে কোথায় কখন, কীভাবে হত্যার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালত তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন তা তার বোধগম্য নয়।
জনাব মুজাহিদ নগণ্য কোনও ব্যক্তি নন; এই দেশের ইসলামী আন্দোলন ও অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের মহাসচিব। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রিত্বকালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দল প্রীতি অথবা ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনও অভিযোগ উঠেনি এবং এমনকি মন্ত্রিত্বের পরও সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার থেকে শুরু করে প্রতিহিংসাপরায়ণ আওয়ামী লীগ সরকার পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার অথবা তার মন্ত্রণালয়ে সংঘটিত কোনও অনিয়ম তালাশ করে পায়নি। সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে তিনি মন্ত্রিত্ব করেছেন, সর্বদা দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার মতো স্বনামধন্য একজন ব্যক্তিকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী হিসেবে কি অপরাধে, কাকে, কখন, কিভাবে হত্যার অভিযোগে ফাঁসির মতো দণ্ড তিনি পেয়েছেন তা জানার তার অধিকার রয়েছে। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি তা জানেন না। তার এই আক্ষেপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যে মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য আমরা উদগ্রীব তার স্বার্থে এই বিষয়টির সুরাহ হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
জনাব মুজাহিদের মৃত্যুদ- নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তিত্ব তাদের মতামত ও উদ্বেগ পেশ করেছেন। খ্যাতনামা বৃটিশ আইনজীবী ও পার্লামেন্টারিয়ান এবং মানবাধিকার প্রবক্তা লর্ড কার্লাইল এই বিচারকে ন্যায়ভ্রষ্ট ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিচারের মান, সাক্ষীদের সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা, আদালতের কথিত বৈষম্যমূলক আচরণ, বিচারকদের নিরপেক্ষতা প্রভৃতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এবং বলেছেন যে, যে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে জনাব মুজাহিদকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে তা নিম্নমানের এবং তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই।
ব্রাসেলস ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা নো পিস উইদাউট জাস্টিস (ঘচডঔ) নন ভায়েলেন্ট রেডিক্যাল পার্টি ও এনআরপিটিটি এই রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে রোম সংবিধি অনুযায়ী ভিক্টিমের সঠিক বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। সংস্থার আইন উপদেষ্টা এলিসন স্মীথ কর্তৃক প্রদত্ত এই বিবৃতিতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া ও ন্যায্যবিচার নিশ্চিত না করায় তাদের অব্যাহত উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয় ইতঃপূর্বে এই ট্রাইব্যুনাল যেসব রায় দিয়েছিল তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল যথেষ্ট উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল, কেননা যে প্রক্রিয়ায় সেখানে বিচার কাজ চলেছে তাতে অভিযুক্তের ন্যায়বিচার পাওয়ার ন্যায্য অধিকার বারবারই লঙ্ঘিত হয়েছে। তাদের মতে মুজাহিদের মৃত্যুদ-ের রায়টি হচ্ছে সেই ভ্রান্ত বিচার প্রক্রিয়া ও অন্যায্য রায়ের সর্বশেষ উদাহরণ। বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগের পেছনে আরও যেসব কারণ ছিল তার মধ্যে রয়েছে আইসিটির বিচারকদের আইনের মূলনীতিসমূহ প্রয়োগে ব্যর্থতা, আসামী পক্ষের সাক্ষীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে সীমিত করে দেয়া প্রভৃতি। বিবৃতিতে বলা হয় যে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়ে অভিযোগের তদন্ত করা হয়েছে এবং তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। এতে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ড স্থগিত করে বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত রোম সংবিধি অনুযায়ী অভিযুক্তদের জন্য সঠিক বিচার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানানো হয়।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠনসমূহ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের প্রয়োগ ও মান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে তাকে গ্রহণযোগ্য মানে উন্নীত করার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ পেশ করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তার কোনটিই গ্রহণ করেননি। অভিযুক্তদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফৌজদারী আইন ও সাক্ষ্য আইনের কার্যকারিতা স্থগিত রাখা ছাড়াও তাদের বেলায় সংবিধান প্রদত্ত মানবাধিকারসমূহও বাতিল করে রাখা হয়। ফলে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবার একটি ধারণা তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় এবং বাস্তবে তার প্রতিফলনও ঘটে। এ প্রেক্ষিতে এনপিডব্লিউজে'র দাবি অনুযায়ী রোম সংবিধি অনুযায়ী ভিকটিমদের সঠিক বিচার নিশ্চিত করার আহ্বানের যৌক্তিকতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এখন বুদ্ধিজীবী হত্যা ও তার সাথে জনাব মুজাহিদের সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু বলা জরুরি বলে আমি মনে করি।
এই স্তম্ভে আমি বহুবার বলেছি যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার মানবিক বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এর গভীরে গিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা না করে ঢালাও দোষারোপের মাধ্যমে তারা জাতির একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে বিভ্রান্ত করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ও আচরণে তারা কখনো অকৃত্রিম ও আন্তরিক ছিলেন না। তারা আজ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় রয়েছেন। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও তারা নিহত বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করতে পারেননি। ১৯৭২ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রকাশনায় ২২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ৫৯ কলেজ শিক্ষক, ২৭০ জন মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক, ৬৩৯ জন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, ১৩ জন সাংবাদিক, ৫০ জন ডাক্তার এবং অন্যান্য পেশার ১৭ জন মিলিয়ে ১০৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এই তথ্য সূত্রের ভিত্তিতে ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ সংগ্রহের চেষ্টা করে। কিন্তু তা কখনো পাওয়া যায়নি। ঐ বছরই ১৪ জন বুদ্ধিজীবীর স্মৃতির একটি প্রদর্শনী হয়। ১৯৮৫ সালে একাডেমির তরফ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিকোষ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় এবং এতে ২৫০ জনের অনেকেরই আবাসিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর ১০ খন্ডে তারা স্মৃতি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যাতে ২৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় স্থান পায়। এই ২৩৮ জনের বাইরে একাডেমি আর কোনও তালিকা সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ একাধিকবার ক্ষমতায় গিয়েও এই অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করেনি। তাদের প্রথম মেয়াদে বুদ্ধিজীবী হত্যার রহস্য উন্মোচনের জন্য জহির রায়হানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। জানা যায় যে, উক্ত কমিটি অপরাধীদের চিহ্নিত করে অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণও সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু সংগৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণ আওয়ামী লীগের অনুকূলে ছিল না। ফলে তদন্তের ফলাফল রসাতলেই শুধু যায়নি জহির রায়হান তথ্য-প্রমাণসহ অপহৃত হয়ে নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতেও বাধ্য হয়েছেন। বলাবাহুল্য, ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জহির রায়হান ঘোষণা করেন যে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পেছনের নীলনকশা উদ্ঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র প্রামাণ্য দলিল তার কাছে আছে যা প্রকাশ করলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নেয়া অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে। তিনি ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবে এ সংক্রান্ত একটি ফিল্ম শো প্রদর্শনেরও ঘোষণা দেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ৩০ জানুয়ারি সকালেই তার কায়েতটুলির বাসায় একটি টেলিফোন আসে যাতে বলা হয় তার বড় ভাই (নিখোঁজ) শহীদুল্লাহ কায়সার মীরপুর ১২নং সেকশনে আছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি সকালেই ভারতীয় বাহিনীর এক মেজরের সাথে মীরপুর যান। জহির রায়হান আর বাসায় ফিরে আসেননি। তার এই অন্তর্ধানকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু লেখালেখি হয়েছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। দৈনিক আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর '৯৩ সংখ্যায় "জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়" শিরোনামে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। এতে জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ একজন নেতার কথিত মন্তব্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। জহিরের নিখোঁজ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হবার পর ঐ নেতা নাকি জহিরের বড় বোন নাফিসা কবিরকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, "জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এরকম চীৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে।" জহির বড় ভাই-এর সন্ধানে গিয়ে নিখোঁজ হন এবং প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যা সংক্রান্ত যে তথ্যপ্রমাণ তার কাছে ছিল এবং তিনি ৩০ জানুয়ারি যা প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা যাতে করতে না পারেন তার জন্যেই তাকে অপহরণ করে রফিক নামে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেছিল। পত্র-পত্রিকায় এই তথ্যও প্রকাশিত হয়েছিল। এই রফিকের রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামী লীগ প্রকাশ করেনি এবং জহির হত্যার বিচারও করেনি। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রকৃত রহস্য এখানেই নিহিত। এই রহস্যের কূল-কিনারা না করে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর দোষ চাপিয়ে তাদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করছে বলে দেশবাসী মনে করেন। এমতাবস্থায় জনাব মুজাহিদের পক্ষে আক্ষেপ করা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তিনি ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন। কেন পেয়েছেন তিনি যেমন জানেন না, যারা দণ্ড দিয়েছেন তারাও সম্ভবত জানেন না। এমতাবস্থায় ইনসাফের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে গঠিত একটি নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
No comments:
Post a Comment