শহর পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে ব্রিটিশরা এদেশে দলিত সম্প্রদায়দের লোকদেরকে নিয়ে এলেও বেশিরভাগ সরকারি অফিসেই এখন তারা আর কাজ পাচ্ছেন না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে তাদের অবস্থান শতভাগ থেকে কমে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশে। আর থাকার জায়গায় উচ্ছেদ আতঙ্ক আটকে রেখেছে অনিশ্চিত জীবনে।
মহাত্মা গান্ধী 'দলিত'দের নাম বদলে রেখেছিলেন 'হরিজন'। তাতেও অবশ্য সমাজে ওদেরকে দেখার ভঙ্গি এতটুকু পাল্টায়নি। ওরা অস্পৃশ্য - যেন ছুঁলে পরে জাত যাবে। রাজধানীর গণকটুলি, মিরনঝিল্লি,টিটিপাড়া, ওয়ারি, নাজিরাবাজার, সায়েদাবাদ, গাবতলী আর আগারগাঁওয়ে বসবাস করা এই দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের একটা বড় অভিযোগ, দেশের আদম শুমারিতে কখনোই আলাদা করে তাদেরকে গণনা করা হয় নি ।
কয়েকশ বছর আগে ব্রিটিশরা রেলওয়ের পরিচ্ছন্নতার কাজে ভারতের মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ, কানপুর, বিহার থেকে এই দলিতদের নিয়ে আসে। তখন থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে তারাই ছিলেন শতভাগ। চলছিলও তেমন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে তাদের চাকরির সুযোগ।
তাদের জন্য মাত্র ১১ ফুট বাই ৯ ফুট মাপের ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে সরকার থেকে। এসব কোয়ার্টারে বিশুদ্ধ পানি আর গ্যাস সুবিধার তীব্র অভাবের মধ্যে কোথাও কোথাও এক ঘরে থাকছেন তিন প্রজন্ম । নিম্নবর্ণের হওয়ায় হিন্দু সমাজের মূল ধারায় যেমন তারা অচ্ছু্ৎ, তেমনি হরহামেশাই মুসলিমদের দখল-সন্ত্রাসের কবলে পড়তে হচ্ছে তাদের।
শুধু থাকার জায়গা বা জাত সুইপার হিসেবে সরকারি চাকরি না পাওয়ার যন্ত্রণার সঙ্গে শিক্ষা থেকে বঞ্চনা দলিত সম্প্রদায়ের ক্ষোভের আরেকটি কারণ। সাধারণ স্কুলগুলোতে দলিত সন্তানরা ভর্তি হতে পারে না। আর পরিচয় গোপন করে উচ্চ শিক্ষা নিলেও সম্মানজনক চাকরি বরাবরই তাদের যোগ্যতাকে অসম্মানিত করছে।
'শিক্ষা মৌলিক অধিকার' সংবিধানের এ কথাটির যেন কোনোই মিল খুঁজে পাওয়া যায় না দলিতদের জীবনে। তাদের বেশিরভাগ শিশুই স্কুলে যায় না। স্কুল কর্তৃপক্ষ যে ভর্তি নেয় না এমন না। আসলে ভর্তি হওয়ার পর আর টেকা যায় না। নিতে হয় ছদ্মা নাম-পরিচয়।
কয়েকশ বছর ধরে এদেশে বসবাস করলেও তাদের প্রতি অবহেলাই বাংলা শেখায় তাদেরকে নিরুৎসাহিত করেছে। এসব দলিতদের অনেকেই বাংলা বোঝেন না এক বর্ণও। বলতে পারাতো দূরের ব্যাপার। কথা বলেন তেলেগু ভাষায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে, পরিচয় গোপন করে চাকরিতে ঢোকার পর পরিচয় ফাঁস হয়ে গেলে অচ্ছুৎ হয়ে পড়েছেন অনেকে- এমন উদাহরণ অনেক।
এরকম নানা অধিকারহীনতা, বঞ্চনা আর সামাজিক ঘৃণাকে একপাশে ঠেলে, কাজের অবসরে তারা জমিয়ে বসেন, গানের আড্ডায়। মাতিয়ে রাখেন নিজেরাই নিজেদের।
No comments:
Post a Comment