Sunday, May 10, 2015

বাণিজ্যে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ : দলের খবর নেই, নেতারা সরাসরি ব্যবসার মালিকানায়

বাণিজ্যে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ : দলের খবর নেই, নেতারা সরাসরি ব্যবসার মালিকানায়



সাংগঠনিক কাজে খবর নেই। আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যস্ত নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে একই অবস্থা। শুধু দলই নয়, সহযোগী সংগঠনের নেতারাও বাণিজ্যে ব্যস্ত। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীও নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়েছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে দলের। সদ্য সমাপ্ত তিন সিটি নির্বাচনেও সাংগঠনিক সংকটের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের জাতীয় পর্যায়ের নেতারা ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিভিশন, পাওয়ার প্লান্ট, গ্যাস প্লান্টসহ বিভিন্ন শিল্প কল-কারখানায় সরাসরি নিজের নামে, স্ত্রী কিংবা আত্মীয়স্বজনের নামে মালিকানা নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের লাইন্সেন্স পাওয়ার পর মালিকানা বিক্রি করে দিচ্ছেন অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে।

এদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থক পেশাজীবী নেতারাও বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কারণে সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশনে দেখা গেছে, কর্মীরা মাঠে খেটেছে, নেতাদের দেখা মেলেনি। নেতারা করেছেন গ্রুপিং। আবার বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই সাংগঠনিকভাবেও নিষ্ক্রিয় কিংবা অদক্ষ ও ব্যর্থ।  এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'ব্যবসায়ীরা     রাজনীতি করবেন, এটিই স্বাভাবিক। কেননা প্রত্যেকেরই রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবসা করার প্রবণতা রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়।' 

জানা যায়, এমন অনেক নেতা আছেন যারা ব্যবসায়ী নন, কিন্তু সাংগঠনিক কাজে নিষ্ক্রিয়। সাংগঠনিক কাজে কারোরই মন নেই। জেলা-উপজেলা নেতাদের মনোযোগ বেশি ঠিকাদারি ব্যবসায়। এমনকি গত ছয় বছরে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, সংঘর্ষ ছিল একটি নিয়মিত বিষয়। কেন্দ্র থেকে মাঠে নেতাদের ব্যবসাই এখন মুখ্য। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি পরিবর্তন না হলে আগামীতে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অনেক কিছুই অবহিত। তিনি বাস্তবমুখী ভূমিকা না নিলে এবং ব্যবসায়ী কেন্দ্রীয় নেতাদের কবল থেকে দলকে মুক্ত না করলে আগামীতে আওয়ামী লীগকে আরও গভীর সংকটে পড়তে হবে। 

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে গত সাড়ে ছয় বছরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। ফুলেফেঁপে উঠেছে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য। অর্থ আয়ের তীব্র প্রতিযোগিতায় মেতেছেন নেতারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই ব্যস্ত থাকছেন নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যে। দলীয় কর্মসূচিতে মন নেই কারও। ফলে দল ক্ষমতায় থাকলেও কাটছে না সাংগঠনিক স্থবিরতা। জেলায় জেলায় আরও বিবর্ণ চেহারা। দিবসভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়া স্থানীয় নেতাদের দেখা যায় না দলীয় কর্মকাণ্ডে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফর হয় কালেভদ্রে। দলীয় সংসদ সদস্যরা ব্যস্ত নিজস্ব সিন্ডিকেট বাণিজ্য নিয়ে। 

ক্ষমতার দাপটে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন সরকারদলীয় এমপিরা।আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুলও দলে কখনো সক্রিয়, কখনো নিষ্ক্রিয়। তৃণমূলের নেতারা তার সাক্ষাৎ পান না। সাংগঠনিক সম্পাদকরাও নিষ্ক্রিয়, গণবিচ্ছিন্ন, কর্মীবিমুখ। এমনকি নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায়ও কদর নেই তাদের। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগগুলোতেও ব্যবসায়ী নেতারা তাদের পছন্দের তালিকায়। সাংগঠনিকভাবে দক্ষ নেতা-কর্মীরাও এসব নেতার ওপর ক্ষুব্ধ। বেশির ভাগ প্রেসিডিয়াম সদস্যেরই দলে ভূমিকা নেই। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ছাড়া অনেকের দেখা মেলে না সাংগঠনিক কাজেও। এমন দু-একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য আছেন, যারা এখনো তৃণমূল নেতাদের কাছে অপরিচিত। দলের যে কোনো সংকটে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ভরসা। দলের মাঠের নেতা-কর্মীরা মনে করেন। দলের সুদিনে অনেকের দেখা মিললেও দুর্দিনের কাণ্ডারি শুধুই সভানেত্রী।  

এ প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের প্রবণতা নতুন কিছু নয়। এটি ৪০ বছর ধরেই চলে আসছে। কখনো ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করছেন, কখনো বা রাজনৈতিক দলের নেতা ক্ষমতায় গিয়ে ব্যবসা করছেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, এই মুনাফালোভী রাজনীতিকরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছেন। অন্যদিকে ক্ষমতার কারণে তাদের শাস্তির আওতায়ও আনা সম্ভব হচ্ছে না। এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, প্রথমত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। 

দ্বিতীয়ত দলের স্বার্থে ব্যক্তির ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবেই যদি রাষ্ট্রকাঠামো চরম ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়। সংসদ সদস্য হয়ে কিংবা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যদি কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন তাহলে সেটি সংবিধান অনুযায়ী সংসদ অবমাননার শামিল বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, 'ব্যবসা ক্ষেত্রে কিংবা অন্য যে কোনোভাবে যদি কোনো সংসদ সদস্য দুর্নীতিগ্রস্ত হন তবে তা সম্পূর্ণরূপে সংসদ অবমাননার শামিল। সে কারণেই এমন কোনো আচরণ যা সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করে তা করলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রয়েছে। ভারতীয় লোকসভায় দুর্নীতি করার কারণে অনেকে বরখাস্ত হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটিই হওয়া উচিত।' 

http://www.bd-pratidin.com/lead-news/2015/05/10/80273

No comments:

Post a Comment