Tuesday, February 24, 2015

মমতা ভাসল পানিতে ইলিশে, বাঙালির বেগুন নাই ফরিদা আখতার


মমতা ভাসল পানিতে ইলিশে, বাঙালির বেগুন নাই

   ফরিদা আখতার

btbrinjal

পশ্চিম বঙ্গের মূখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বাংলাদেশে এসে ঘুরে গেছেন। তাঁর ৪০ জনের বেশি সফর সঙ্গীর মধ্যে ছিলেন কবি সুবোধ সরকার,চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষ ও ব্রাত্য বসু,অভিনেত্রী মুনমুন সেন,অভিনেতা প্রসেনজিৎ,দীপক অধিকারী (দেব)ও অরিন্দম শীল,কণ্ঠশিল্পী নচিকেতা ঘোষ ও ইন্দ্রনীল সেন,কবি কাজী নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী। এ ছাড়া ছিলেন শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়া ও সঞ্জীব গোয়েঙ্কা এবং একদল সাংবাদিক। ভারতীয় সাংবাদিকরা এই সফর নিয়ে কি লিখছেন আমি সে প্রসঙ্গে যাব না। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় যা উঠেছে এবং টিভি চ্যানেল যেভাবে কভার করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাতে মনে হয়েছে এবার সরকারের একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিটাই মমতা-কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সারাদিন মমতা নিয়ে লাইভ শো কিংবা সংবাদ শিরোনাম। মমতা সন্তুষ্ট মনেই রাতে ফিরে গেছেন। বিএনপির সাথে কোন রকম যোগাযোগ না করে বার্তা দিয়ে গেলেন তিনি শেখ হাসিনার পছন্দের মানুষ। তাঁর হাসিনাদি। কাজেই হাসিনাদি পছন্দ করেন না এমন কারো সাথে দেখা করে কাজ নেই।
বাংলাদেশের মানুষ ভোলেনি বিগত কংগ্রেস সরকারের পক্ষে মনমোহন সিংয়ের যে সরকারি সফর ছিল তাতে তিস্তা চুক্তি প্রায় হয় হয় অবস্থায় গিয়েও হতে পারে নি, মমতার আপত্তির কারনে। এবার তাই তিনি যখন এলেন এবং 'আশ্বাস' দিলেন, তখন সবাই খুব উল্লসিত হয়ে উঠলো। অথচ উল্লসিত হবার মোটেও কোন কারণ নেই, কারণ আশ্বাস মানেই 'অঙ্গীকার' নয় এবং 'অঙ্গীকার' মানেই বাস্তবায়ন নয়। এটা ছোট বাচ্চাদের খেলা নয় যে পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার বিষয়টি শুধু কলকাতার দিদির আশ্বাসে ঘটে যাবে। মমতা সোজাসাপ্টা কথা বলেন, পরিষ্কার ভাবে বলেছেন আমাদের কিছু সমস্যা আছে, আপনাদেরও কিছু সমস্যা আছে। দুদিকের স্বার্থ বিবেচনা করেই পানি দিতে হবে। তাহলে তিনি কিভাবে বললেন, 'আমার ওপর আস্থা রাখুন'। কীসের আস্থা? তিস্তা নদী এখন শুকিয়ে আছে। তিস্তা পারের উত্তরাঞ্চলের মানুষ এই শুকনো মৌসুমে পানি পাবে কিনা সেটা পরিষ্কার ভাষায় শুনতে চায়। 'আশ্বাস' বা আস্থার কথায় তাদের চিড়া ভিজবে না।
মমতা পশ্চিম বঙ্গের মানুষ। আমরা জানি বাংলাদেশের যে কয়েকটি জিনিসের ওপর তাদের বিশেষ নজর আছে তার মধ্যে ইলিশ ও জামদানী শাড়ী রয়েছে। ইদানিং দাবি করা হচ্ছে, 'জামদানী' কলকাতায় বোনা হচ্ছে, অথচ 'জামদানি'র যে ভৌগলিক লক্ষণচিহ্ন (geographical indicator) তার ওপর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির দাবিদার একান্তই ঢাকা। জামদানি ডেমরা ছাড়া বাংলাদেশেরও আর কোথাও হয় না। ডেমরার তাঁতীরা ছাড়া এই বিশেষ ধরণের শাড়ি আর কেউই বুনতে পারে নৎ। বুনলেও সেটা ভাল শাড়ি হতে পারে, কিন্তু তাকে 'জামদানি' বলা যাবে না। 'জামদানি' মানেই 'ঢাকাই জামদানি'। 'জামদানি'কে অন্য কেউ নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বলে দাবি করলে সেটা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর যেমন আঘাত হয়, একই ভাবে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকেও অন্যায় করা হয়। ঢাকাই জামদানি একেবারে এলাকার নির্দিষ্ট দক্ষতা্র ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এর আগে ফুলিয়া ও সমুদ্রগড়ে টাঙ্গাইলের বসাক পরিবারদের নিয়ে গিয়ে টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের ক্ষতি করেছেন। এখন খোদ টাঙ্গাইলেই কলকাতা থেকে টাঙ্গাইল তাঁতীদের বোনাকাপড় আসে অনেক চড়া দামে। জামদানীও এক পর্যায়ে তাই হবে হয়তো। আমরা জামদানী পরবো ভারত থেকে এনে! ঢাকা থেকে জামদানি বুনা উঠে যাবে। এই দুর্ভাগ্যও হতে পারে। এই আশংকার মধ্যে আমরা আছি। মমতা ব্যানার্জির ব্যাবসার দিকনির্দেশনাকে এই সকল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বিচার করতে হবে। তিনি বাংলাদেশের বন্ধু নাকি প্রতিপক্ষ তার প্রমাণ পেতে আমাদের পর্যবেক্ষণ আরও তীক্ষ্ণ ও সুদূরপ্রসারী হতে হবে। এই পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ভারত থেকে যারা রাজনৈতিক সফরে আসেন তাঁরা নির্দিষ্টভাবে অনেক কিছুই নিয়ে যান, বিনিময়ে কিছু কথাসর্বস্ব আশ্বাস ও ভরসা দিয়ে যান যা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। মমতার আশ্বাস তাই জনমনে খুব আশার আলো জাগাতে পারে নি। দুঃখিত।
মমতা ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন এটা খুব ভাল কথা। পশ্চিম বঙ্গে বাংলা ভাষা মৃত্যুর আগের অবস্থায় 'লাইফ সাপোর্টে' আছে, অথচ বাংলাদেশে এই দিবসটি কত ঘটা করে এবং সর্ব স্তরের মানুষের সাথে মিলে কত মর্যাদার সাথে পালিত হয়। তবু বলব একুশ পালন আমাদের বাহ্যিক দিক, ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি এবং আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গোড়ায় রয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতি সরব উপস্থিতি। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা আমাদের মধ্যে একাকার হয়ে আছে। একই কথা পশ্চিমবাংলা সম্পর্কে খাটে না। পশ্চিম বাঙলার মানুষ বাংলা ভাষাকে কম ভালবাসে সেটা দাবি করি না, কিন্তু সেটা তাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার বাইরের চর্চার বিষয়।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে মমতা ব্যানার্জি ভোর রাত থেকেই ব্যস্ত ছিলেন। সেদিনই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার বৈঠক হয়, এবং পরে তাঁরা একসঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন। বিডিনিউজ২৪. কম এর সৌজন্যে খাবার মেনু সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জা্নতে পারি। খাবারের আয়োজনে ছিল ইলিশের প্রাধান্য, ভাপা ইলিশ, সর্ষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ আর ইলিশের ডিম ভাজা।এছাড়াও ছিল চিতল মাছের কোপ্তা,রুই মাছের তরকারি, খাসির রেজালা ও হাড়ছাড়া মুরগির মাংসের তরকারি। খাবার শেষে রসমালাই ও মিষ্টি দইও পরিবেশন করা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের সব ধরণের জনপ্রিয় খাবার দেয়া হয়েছে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস, ইলিশ খাওয়ার জন্যে এটা খুব ভাল সময় নয়। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মাছ ডিম পাড়ে অল্প সময়ের জন্য, আর বেশিরভাগ ডিম পাড়ে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে। এই সময় ইলিশ মাছ অনেকেই খান ন

ইলিশের আইটেম বেশী হলেও ইলিশের সাথে একটি সব্জি খুব ভাল লাগে সেটা হচ্ছে বেগুন। সেটা মেনুতে ছিল কিনা বোঝা যায় নি। কৃষকরা একটি বিশেষ বেগুনের চাষ করেন শুধু ইলিশের সাথে রান্নার জন্যে। টাঙ্গাইলের কৃষক আক্কাস আলী বেগুন নিয়ে গান রচনা করেছেন। মমতা ব্যানার্জী মাটি নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তাঁর হয়তো বেগুনের এই গান ভাল লাগতে পারে। এখানে ইলিশের জন্যে কাঁটা চিকন ডিম বেগুনের উল্লেখ আছে। নিশ্চয় পশ্চিম বাংলায়ও ইলিশের সাথে স্থানীয় জাতের বেগুনের রান্না হয়। গানের মাঝের কলি এই রকমঃ

কামরাঙ্গা, ভোলানাথ, আর কাঞ্চন বারমাসে
ও ভাই বোন কাঞ্চন বারমাসে
কাটা চিকন ডিম বেগুনি তরকারী ইলিশ মাছে রে।।

শুটকী মাছে লম্বা বেগুন, শৈল বোয়াল রুপিয়াজী
ও ভাই বোন শৈল বোয়াল রুপিয়াজী


আমার দেশী জাতের বেগুনে নাই কোন টেকনলজি।।

আমার সোনার ভাই বোন রে।।
কৃষক আক্কাস আলী গানটি লিখেছিলেন বিটিবেগুনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সচেতন করবার জন্য। মমতা বেগুন নিয়ে জেনেটিক কারিগরির কাহিনী কতোটা জানেন, জানি না, কিন্তু বাংলাদেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এই সব্জির ওপর কোম্পানির দখলদারি বন্ধের আন্দোলনে সংহতি জানাতে পারতেন।
বাংলাদেশ থেকে মমতার কাছে চাওয়া পাওয়ার দিক ছিল তিস্তার পানি, কিন্তু তিনি গঙ্গা-যমুনার কথাই বেশী বলছিলেন। অন্যদিকে তিনি শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে তার রাজ্যে ইলিশ না পাওয়ার অনুযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'ইলিশ খুব কম পাচ্ছি'। কম পাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে দেশের চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন সময় তা রপ্তানি বন্ধ রাখে বাংলাদেশ সরকার।এটা নিঃসন্দেহে সঠিক সিদ্ধান্ত। এমন কি দেশেও বছরে কয়েকটি সময় ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইলিশ কোন শিল্প পণ্য নয় যে চাহিদা বেশী থাকলেই যে কোন সময় উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়া যেবে। উত্তরে হাসিনা বলেন, 'পানি এলে ইলিশও যাবে'। ২২ তারিখের পত্রিকায় এটাই প্রধান শিরোনাম হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানির অভাবের কথা শোনান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মমতাও কম যান না। তিনি বলেন, তিস্তায় ইলিশ হয় না, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনায় হয়। অর্থাৎ তিনি ইলিশ নেবেন, কিন্তু পানির ব্যাপারে শুধু 'আশ্বাস' দেবেন, সরবে তাঁর ওপর আস্থা রাখবার আব্দার জানাবেন। এটা হয় না। এক কথায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন তিস্তার পানির সাথে ইলিশের সম্পর্ক নাই। তিস্তার পানি দিতে হলে তাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্তেই দেবেন।
দুই
ইলিশ প্রসঙ্গে বলতে হলে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের জন্যে এখন হুমকি হয়ে উঠেছে। সেটা হচ্ছে কৃষিতে বায়োটেকনোলজির ব্যবহার কিংবা জেনেটিকালী মডিফাইড ফসলের প্রবর্তন। ভারতে কংগ্রেস সরকার জেনেটিকালী মডিফাইড বিটি তুলার চাষ শুরু করার পর ক্ষতিগ্রস্ত বিপুল সংখ্যক কৃষক আত্মহত্যা করেছে। এখনো করছে। কিন্তু ভারতে এখনো কোন খাদ্য ফসলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার হয় নি। বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তোর সাথে পার্টনারশীপে ভারতের মাহিকো কোম্পানি বিটি বেগুনের গবেষনা শুরু করে। এই গবেষনা একই সাথে ভারত,ফিলিপাইন ও বাংলাদেশে শুরু করা হয়েছিল ইউএসএআইডির বিশেষ কর্মসূচি Agriculture Biotechnology Support Project (ABSP II)-এর অধীনে। কিন্তু এ দুটি দেশে চাষের ছাড়পত্র পায় নি। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টোর স্থানীয় সহায়ক মাহিকো উদ্ভাবিত বিটি বেগুন ছাড়ের উপর নিষেধাজ্ঞা বা মরাটোরিয়াম জারি করেছে ২০১০ সালে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্যানেল অনির্দিষ্ট কালের জন্য জিএম ফসলের সব রকম মাঠ পরীক্ষা বন্ধের সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে ফিলিপাইনের কোর্টে গ্রীনপিস দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের গবেষণা বন্ধের জন্যে আদেশ দেয়া হয়েছে (Philippines Court of Appeals issues writ against trials for Bt Brinjal, May 25, 2013 FnBnews.com) । এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করা হলে সেখানেও নিষধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়। ভারতে ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়ে তারা ফিলিপাইনে চেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের শেষ চেষ্টা ছিল বাংলাদেশ। তাই গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে সম্পুর্ণ নিশ্চিত না হয়েই তারা কৃষক পর্যায়ে উন্মুক্ত চাষের অনুমতির জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকুক বা না থাকুক। বাংলাদেশের বিটি বেগুন চাষের অনুমোদনের মধ্যে সেটাই হয়েছে। পরিবেশ সংগঠন, কৃষক সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিজ্ঞানীদের সকল উদ্বেগ, উৎকন্ঠার কোন রকম তোয়াক্কা না করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে ৩০ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে শর্তযুক্ত সীমিত পর্যায়ে চাষের অনুমতি দিয়েছে। এখন তারা সম্প্রসারণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভারতের সাথে পানি নিয়ে যতো ঝামেলাই থাকুক না কেন খুব সহজেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) বিটি বেগুনের বীজ ভারতের মাহিকো কোম্পানি থেকে আনতে পেরেছে, বলা যায় বারিকে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বারির কাজ হচ্ছে কৃষকদের দিয়ে এর পরীক্ষা করানো। এখানে বিজ্ঞানের দিক থেকে কোন অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয় নেই, কারণ প্রযুক্তি ও তার তত্ত্বাবধান সব কিছুই আসছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বারি গাজীপুর কার্যালয়ে নিজ জমিতে ২০০৫ থেকে গবেষণা শুরু করেছে। আশ্চর্য যে, ভারতে যা হতে দেয়া হয় নি, সেই কাজ ভারতের কোম্পানির সহযোগিতায় বাংলাদেশে বিটি বেগুন বাজারজাতের জন্যে কাজ করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের কিছু অংশ বেগুনের আদি উৎপত্তিস্থল হলেও ভারত তাদের নিজেদের আদি জাতের বেগুন বহুজাতিক কোম্পানিকে দেয়নি। অথচ বিটি বেগুনের গবেষণা ফলাফলের অপেক্ষা না করেই চুক্তির মাধ্যমে বেগুনের মেধাস্বত্ব বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবে কোম্পানির ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ে ফেলেছে। চুক্তিটি ২০০৫ সালের ১৪ মার্চ বারি,মার্কিন বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টোর পক্ষে ভারতীয় কোম্পানি মাহিকো ও সাতগুরু ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সাব-লাইসেন্স চুক্তি অনুসারে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে উৎপাদিত বিটি বেগুনের মেধাস্বত্ব মনসান্টো ও মাহিকো কোম্পানির হাতে চলে গেছে। চুক্তিটির আর্টিকেল ১.১৯ ধারায় বলা হয়েছে,বিটি বেগুন বীজের মেধাস্বত্ত্ব মনসান্টো-মাহিকো কোম্পানির। আর্টিকেল ১.৬ ধারায় বলা হয়েছে,বিটি বেগুনের বীজ কোম্পানির কাছ থেকে কিনে নিতে হবে। এ চুক্তির আর্টিকেল ৯.২(গ)অনুসারে বিটি বেগুন বীজের বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকার মনসান্টো-মাহিকো কোম্পানির। বিটি বেগুন বীজ ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। চুক্তির ১.১৯ ও ১.৬ ধারা অনুসারে বাংলাদেশের নিজস্ব জাতের ৯টি বেগুন, যেগুলোয় বিটি জিন সংযুক্ত করা হয়েছে,সেগুলোর মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাবে। আর্টিকেল ৯.২(গ)-এ বলা হয়েছে,বিটি বেগুন বীজের ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক এবং মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। উল্লেখ্য,বাংলাদেশে বিটি জিন প্রয়োগ করা নয়টি জাত হলো— উত্তরা,কাজলা,নয়নতারা,সিংনাথ,চেগা,ইসলামপুরী,দোহাজারী ও আইএসডি ০০৬।

বাংলাদেশের মতো ভারতেও বেগুনের শত শত জাত রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেগুনের জাতগুলো কৃষকের হাতছাড়া করতে বাংলাদেশের সরকার এবং কোম্পানি একসাথে মিলেছে। ভারত সেদিক থেকে সতর্ক রয়েছে। বর্তমানে ভোটছাড়া 'নির্বাচিত' কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। তারা দেশের একটি গুরুত্বপুর্ণ ফসলের মেধাস্বত্ব নির্বিচারে মার্কিন কম্পানি মনসান্তো ও ভারতীয় কোম্পানি মাহিকোকে দিয়ে দিচ্ছে। প্রাণবৈচিত্রের ক্ষতি ঘটাচ্ছে ভুল কৃষি নীতি ও কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে। জিএমও খাদ্য ফসল ভোগের পর মানবদেহে ক্ষতির সম্ভাবনা নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হলেও তার প্রতি তোয়াক্কা না করেই, এবং প্রথম পর্যায়ে চাষের অভিজ্ঞতায় সফল না হয়েও কৃষি মন্ত্রণালয় এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিটি বেগুন আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামিতে মূখ্য মন্ত্রী মমতা এলে তার সব্জির তালিকায় কি এই বিটি বেগুন থাকবে? ইলিশের সাথে বেগুনের স্বাদ অসাধারণ! কিন্তু বিটি বেগুনের যে ক্ষতি তা কি মমতা মেনে নিতে পারবেন? আমাদের সরকার কি তাদের রাষ্ট্রীয় অতিথিদের এই বিটি বেগুনের তরকারি খাওয়াবেন?
মমতা বন্দোপাধ্যায়ের জন্যে আগামি নির্বাচনে বাংলাদেশের নানা ইস্যু সামনে আসতে পারে। তার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস রপ্তানি হচ্ছে বলে তারা খুব উৎকন্ঠিত। বিটি বেগুন নিয়ে এই সন্ত্রাসের তুলনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার বরাতে বলা হয়েছে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় বিটি বেগুনের বীজ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিমন্ত্রী বেগুন বীজের চোরাচালানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। (প্রথম আলো, ১১ নভেম্বর, ২০১৪) হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার শিরোনামে বলা হয়েছে After terror, Bangladesh sends Bt seeds into India (নভেম্বর ১০, ২০১৪) "Terror is not the only commodity that is entering Bengal through the Bangladesh border. At a time when controversies and debates over the introduction of genetically modified (GM) crops are raging in the country and the scientific community is yet to give its opinion, Bt Brinjal seeds are being smuggled into West Bengal and farmers in the state are believed to have sown the crop in several districts. অর্থাৎ ভারত বিটি বেগুনের বীজের এই চোরাচালানকে সন্ত্রাসের সাথে তুলনা করছে, যার প্রভাব রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্যে খুব বিপজ্জনক হতে পারে।
মমতা এসেছেন হাসি মুখে, যাবার সময় তার হাসি আরো বেড়ে গেছে। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এসেছেন নাকি শুধু একটি দল ও তার সরকারের কাছেই এসেছিলেন তা বোঝা গেল না। তিনি শেখ হাসিনার জন্য নিজের আঁকা একটি ছবি নিয়ে এসেছিলেন। শেখ হাসিনা একটি ছবি এবং ঢাকাই জামদানি দিয়েছেন মমতাকে।
মমতা ব্যানার্জি আমাদের কিছু দিতে পারবেন না, তাঁর কাছ থেকে কিছু চাইবার আছে কি আমাদের? নাই। তবু আমরা চাই বাংলাভাষীদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ুক। প্রত্যাশা যে সেটা যেন খণ্ডিত না হয়। তাঁকে আমরা ভালবাসতে পারি, কোন অসুবিধা নাই। একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর ক্ষমতাও সীমিত।
তারপরও বলব, আবারও আসুন বেড়াতে মমতা -- মুখ্যমন্ত্রী কিম্বা একজন সম্মানিত বাঙালি হিসাবে। কিন্তু আপনার আশ্বাস কিম্বা আপনার ওপর আস্থা রাখবার কথা বলে খামাখা বিব্রত করবেন না আমাদের। নিশ্চিতভাবেই ইলিশ চলে যাবে আর বেগুনের আদি জাত ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ভারতীয় কম্পানিগুলোর তৎপরতা আপনি রোধ করবার দায় বোধ করবেন না। আপনি আমাদের স্বার্থ দেখবেন, সে ভরসা করি না। তিস্তার পানির বন্টনে ভারতীয় অধিকারকেই আপনি অগ্রগণ্য মনে করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবুও আমাদের ন্যায্য পানির হিস্যা চাই, শুধু সীমান্তের ওপারের মানুষদের জন্য নয়, পানি এপারের সব মানুষেরই প্রয়োজন।
তাই আগে তিস্তার পানি আসুক।  শুধু ইলিশ ওপারে যাবে আর বাংলাদেশের বেগুনের ওপর কোম্পানির দখলদারিত্ব থাকবে সেটা মেনে নেয়া যাবে না ।
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
http://chintaa.com/index.php/chinta/showAerticle/300/bangla



Get your own FREE website, FREE domain & FREE mobile app with Company email.  
Know More >

No comments:

Post a Comment