পুরনো দিনের বই - তিতাস একটি নদীর নাম
অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪ - ১৯৫১) জন্মেছিলেন কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ গ্রামে। ছেলেবেলাতেই বাবা-মাকে হারান। গ্রামের প্রতিবেশীদের সাহায্য ও আনুকুল্যে ব্রাহ্মণ্বাড়িয়া স্কুল থেকে বৃত্তি পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন। কিন্তু পয়সার অভাবে কুমিল্লা কলেজে পড়া শেষ করতে পারেন নি। লেখার অভ্যাস ছেলেবেলাতেই ছিল। কলকাতায় এসে বিভিন্ন সময়ে নবশক্তি, দেশ, বিশ্বভারতী, মাসিক মোহাম্মদী, নবযুগ, আজাদ, ইত্যাদি অনেক পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। বুদ্ধদেব বসু'র 'এক পয়সায় একটি' গ্রন্থসিরিজে লিখে তিনি প্রথম পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু ওঁর সুখ্যাতি বিস্তৃত হয় মোহাম্মদী-তে 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসটি হারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে সুরু করলে।
'তিতাস একটি নদীর নাম' নিঃসন্দেহে অদ্বৈত অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্যজীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি এবং বাংলা সাহিত্যের একটি মস্ত বড় সম্পদ। প্রতিকুল অবস্থার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন যুদ্ধ করে ধীরে ধীরে ধবংস হয়ে যাওয়া মালো (মত্স্যজীবি সম্প্রদায়)-গোষ্ঠীর কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাস গড়ে উঠেছে। অদ্বৈত নিজে ছিলেন এই সম্প্রদায়ের লোক; মালোদের গ্রামে তিনি বড় হয়েছেন - তাদের জীবন তাঁর অতি-পরিচিত। বড় হয়েও সেই জীবনকে তিনি ভুলতে পারেন নি; ভুলতে পারেন গ্রামের সেই লোকদের। অদ্বৈত নিজে বিয়ে করেন নি। দায়দায়িত্ব না থাকা সত্বেও চিরদিনই ওঁর অর্থকষ্টের মধ্যে কেটেছে। প্রথম জীবনে অর্থ ছিল না। যখন অর্থ এলো, সেগুলি নিদ্র্বিধায় খরচ করেছেন পরিচিত দুঃস্থ মালোদের অন্ন-সংস্থানের জন্য। নিজের জন্য যে বিলাসিতা তিনি ত্যাগ করতে পারেন নি - সেটা হল বই কেনার। অসম্ভব বই পড়তে ভালোবাসতেন। ওঁর সহস্রাধিক বইয়ের সেই ভাণ্ডার এখন রামমোহন লাইব্রেরিতে শোভা পাচ্ছে।
'তিতাস একটি নদীর নাম' মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হতে হতে হঠাত্ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বইটির পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যায় রাস্তায়! বহুদিনের কষ্টের ফসল এইভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ মর্মান্তিক দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু বন্ধìদের ও পাঠকদের উত্সাহে তিনি আবার লিখতে বসেন তিতাসের কাহিনী। দিনের বেলার শত কাজ শেষ করে অনেক রাত্রে ষষ্ঠীতলার ভাড়াটে-অধ্যুষিত একটা পুরনো নোংরা বাড়ির চারতলার ছাদে নিজের ছোট্ট ঘরে পৌঁছে তিনি লিখতেন। স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে লিখতেন তিতাস নদীর পাশে খোলা আকাশের নিচে মালোদের গ্রামগুলির কথা - সেখানকার লোকদের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী। কিন্তু প্রসাদগুণে সেটা শুধু কাহিনী নয় - অনেক জায়গাতেই হয়ে উঠত প্র্রায় কাব্য। বই হিসেবে এটি প্রকাশিত হয় ১৩৬৩ সালে। কাহিনীর শুরু তিতাসকে দিয়ে:
তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।
স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।
ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায় ; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।মেঘনা পদ্মার বিরাট বিভিষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণা পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বৌ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না।
কাহিনী শেষ হয়েছে তিন প্রজন্মের সময়টুকুর মধ্যে একদা প্রাণবন্ত মালোদের গ্রামের মর্মস্পর্শী নিস্তব্ধতায়:
ধানকটা শেষ হইয়া গিয়াছে। চরে আর একটিও ধান গাছ নাই। সেখানে এখন বর্ষার সাঁতার-জল। চাহিলে কারো মনেই হইবে না যে এখানে একটা চর ছিল। জল থৈ থৈ করিতেছে। যতদূর চোখ যায় কেবল জল। দক্ষিণের সেই সুদূর হইতে ঢেউ উঠিয়া সে ঢেউ এখন মালোপাড়ার মাটিতে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে। কিন্তু এখন সেই মালোপাড়ার কেবল মাটিই আছে। সে মালোপাড়া আর নাই। শূন্য ভিটাগুলিতে গাছ-গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া শোঁ শোঁ শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দে তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।
মাত্র ৩৭ বছর বয়সে যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে এই প্রতিভাবান লেখকের মৃত্যু হয়। লেখকের মৃত্যুর বাইশ বছর পরে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশী একটি সংস্থার প্রযোজনায় বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক বইটিকে চিত্রায়িত করেন। ছবিটি জাতীয় পুরস্কারও পায়।
প্রসঙ্গতঃ 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছাড়াও অদ্বৈত মল্লবর্মণ 'সাদা হাওয়া' (উপন্যাস), 'সাগরতীর্থে', 'নাটকীয় কাহিনী', 'রাঙামাটি' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
সুজন দাশগুপ্ত
অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)
Posted 16/04/2009
Filed under: স্মরণীয় |ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক। তিনি ১৯১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি কুমিল্লা কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে তার পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি। জীবিকার অšে¦ষণে তিনি কুমিল্লার বিশিষ্ট চিকিৎসক ও সমাজসেবক ক্যাপ্টেন নরেন্দ্র দত্তের সঙ্গে কলকাতা চলে যান।
কলকাতার 'নবশক্তি' পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাংবাদিকতা শুরু করেন। এ পত্রিকায় তিনি বিশিষ্ট কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহকর্মী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আজাদ, মোহাম্মদী, যুগান্তর ও সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়ও কাজ করেন। তিনি বিশ্বভারতীর সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাহিত্যচর্চাও করতেন। মোহাম্মদী পত্রিকায় 'তিতাস একটি নদীর নাম' শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে তার একটি উপন্যাস প্রকাশ হতে থাকলে পাঠকমহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়েই তিনি লেখক হিসেবে সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু উপন্যাসটি সম্পূর্ণ মুদ্রিত হওয়ার আগেই এর পা-ুলিপি হারিয়ে যায়। তখন শুভার্থী পাঠকদের আগ্রহ ও অনুরোধে তিনি আবার এ উপন্যাসটি রচনা করেন। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পরেই এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন জাতিতে মালো। তিতাস একটি নদীর নাম সেই মালোদেরই জীবনচিত্র। যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা ও তার দেখা বাস্তবচিত্রই তিনি এ উপন্যাসে অকপটে তুলে ধরেছেন। চরিত্র-চিত্রণের নিপুণতা ও গল্প বলার আন্তরিকতায় এটি এক অনন্য সৃষ্টি। এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে একটি মূল্যবান সংযোজন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক ১৯৭৩ সালে এই কাহিনীকে চলচ্চিত্রে রূপদান করেছেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন বিচিত্র পাঠপিপাসু মানুষ। সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, শিল্পকলাÑ সব বিষয়েই তার ছিল সমান আগ্রহ। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যেও তিনি এসব বিষয়ে সংগ্রহ করেছেন সহস্রাধিক দুর্লভ গ্রন্থ। মৃত্যুর পর তার সংগৃহীত গ্রন্থভা-ার রামমোহন লাইব্রেরিকে দান করা হয়।
তিতাসের মালোপাড়ায়
পিয়াস মজিদ | তারিখ: ২৬-০৯-২০০৯
তিতাসপাড়ের অন্ত্যজ মালো সম্প্রদায়ের চিরায়ত সুখ-দুঃখের কাহিনী হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম সাহিত্যিক সীমানা ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে নিম্নবর্গ গবেষকদেরও আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। কেমন আছে অদ্বৈতর মালো সম্প্রদায়? গোকর্ণঘাটের প্রত্যন্ত মালোপাড়া ঘুরে দেখা যায়, অদ্বৈতর উপন্যাসে বিধৃত বাস্তবতার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। যদিও তিতাসের বুকে ঘটে গেছে বহু ভাঙা-গড়ার খেলা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মাইলতিনেক পশ্চিমে গোকর্ণঘাট গ্রাম। সেখানে যেতে যেতে পথে পড়বে লঞ্চঘাট, নৌকাঘাট, জেলা পরিষদ নির্মিত মার্কেট। গোকর্ণ গ্রামের সামনে দিয়ে বয়ে গেছে তিতাস নদী। আশপাশে তিতাস একটি নদীর নাম-এ উল্লিখিত জায়গাগুলো যেন ছবির মতো ভাসছে। সেই রসুলপুর, জগত্বাজার, আনন্দবাজার এমনকি কালীসীমার যে বুড়ো বটগাছের কথা আমরা উপন্যাসে পাই তারও দেখা মিলবে। গোকর্ণঘাট গ্রামে ঢুকতেই যে দৃশ্য তা যেন অনেকটা অদ্বৈতর উপন্যাসের বর্ণনার মতোই 'তিতাস নদীর তীরে মালোদের বাস। ঘাটে বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানো জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তকিল—সুতাকাটার, জাল বোনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালোদের সংসার।'
মালোপাড়ার এই চিরাচরিত দৃশ্যের পাশাপাশি একটি সাইনবোর্ডও বিশেষভাবে চোখে পড়বে। জীর্ণশীর্ণ একটি টিনের ঘরের বহির্ভাগে ঝোলানো সাইনবোর্ডে লেখা আছে 'কালজয়ী উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম-এর লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ এখানে জন্মেছিলেন। তারিখ, জন্ম: ১৯১৪, মৃত্যু: ১৯৫১ ইং গোকর্ণঘাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া'। (তিতাস একটি নদীর নাম ছাড়াও রাঙ্গামাটি, শাদা হাওয়া, ভারতের চিঠি: পার্ল বাককে শীর্ষক তাঁর আরও কয়েকটি উপন্যাস রয়েছে। এ ছাড়া তিনি গল্প লিখেছেন। সংগ্রহ করেছেন লোকসাহিত্য—সংগীত। ভিনসেন্ট ভ্যান গগের জীবনকাহিনী নিয়ে লেখা আরভিং স্টোনের উপন্যাস লাস্ট ফর লাইফ-এর অনুবাদক হিসেবেও তিনি খ্যাত।)
কথা বলি এ ঘরে বসবাসকারী অনিল বর্মণের সঙ্গে। পেশায় তিনি একজন পাকশি বা বাবুর্চি। তিনি জানান, অদ্বৈত মল্লবর্মণ চিরকুমার অবস্থায় ১৯৫১ সালে কলকাতায় মারা যান। তাঁর আত্মীয়স্বজনেরও তেমন কেউ আর এখন অবশিষ্ট নেই। তবে মালোপাড়ার ঘরে ঘরে বেঁচে আছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ।
অনিল বর্মণ তাঁর বাবার কাছ থেকে শুনেছেন অদ্বৈতর কথা। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষজন আসেন অদ্বৈতর মালোপাড়া দেখতে। কিন্তু অদ্বৈতর স্মৃতিরক্ষায় এখানে কিছুই হচ্ছে না বলে তাঁর অভিযোগ। কয়েক বছর আগে গোকর্ণ গ্রামে ১ জানুয়ারি অদ্বৈতর জন্মদিনে 'অদ্বৈত মেলা' অনুষ্ঠিত হতো। স্বার্থান্বেষী মহল সে মেলাস্থলটিও দখল করে নিয়েছে। তা ছাড়া এ গ্রামের 'অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি পাঠাগার'টিও সম্প্রতি উচ্ছেদের কবলে পড়ে। বিস্তারিত আলাপে অনিল বর্মণ জানান মালোদের বিপর্যস্ত জীবনের কথা। পূর্বপুরুষের রীতি অনুযায়ী মাছ নিয়েই মালোদের কারবার। তবে অর্থনৈতিক রূপান্তরের ঝাপটায় মাছ-শুঁটকির পরিসর থেকে মালোরা বর্তমানে অন্যান্য পেশার দিকেও প্রবলভাবে ঝুঁকছে। স্বর্ণকার, ক্ষৌরকার, মিস্ত্রি বা দর্জির কাজে এখন প্রচুর মালো নিয়োজিত।
নদীতে মাছ কম আর মাছের দামও আগের মতো সেভাবে পাওয়া যায় না। মাছের মৌসুমেই দিনে গড়ে মাত্র ১০০ টাকা আয় হয়। আর মালোদের যেহেতু কোনো জমিজমা নেই, খাদ্যশস্য থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই বাজার থেকে কিনতে হয়। ফলে বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে তাল রাখতে গিয়ে প্রায় প্রতিটি মালো পরিবারই নিদারুণ অভাবের সঙ্গে লড়াই করছে। গোকর্ণঘাট গ্রামটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার অন্তর্গত। এখন এখানে ৯৫টি পরিবারের প্রায় ৮০০ মালো বাস করছে। এ ছাড়া এ গ্রামে উচ্চবর্ণের হিন্দুসহ মুসলমান সম্প্রদায়েরও বসবাস আছে।
এখানকার মালো জনগোষ্ঠীর প্রায় পুরো অংশ শিক্ষাবঞ্চিত। স্বেচ্ছায় নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা বলতে এলেন মালো বধূ শিল্পী রানী বর্মণ। তিনি জানান, মালো সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোরেরা স্কুলে গেলেও জীবিকার তাগিদে তেমন কেউই আর বেশি দূর লেখাপড়া চালাতে পারে না। শিল্পী রানী তাঁর ঘরে সযত্নে রক্ষিত অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি বাঁধাই আলোকচিত্র দেখালেন। ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছবিটিও তিনি দেখেছেন। তাঁর আক্ষেপ, আজ অদ্বৈত বেঁচে থাকলে হয়তো মালোদের অবস্থা এমন থাকত না।
মালোদের সাংস্কৃতিক জীবনও আজ নিস্তরঙ্গ প্রায়। দুর্গাপূজা, গঙ্গাপূজা, অষ্টমীস্নান ছাড়াও মাঘমণ্ডলের ব্রত একসময় মালোদের অনিবার্য সাংস্কৃতিক পর্ব ছিল। তিতাস একটি নদীর নাম-এও এ ব্রতের বারংবার উল্লেখ আছে। শিল্পী রানী জানালেন, নদীবাহিত রোগের কারণে মালোদের এ সাংস্কৃতিক পর্বটি আর সেভাবে পালিত হয় না। লোকনাথ বর্মণ নতুন প্রজন্মের মালো। সে গোকর্ণঘাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। কথায় কথায় বলল, অদ্বৈত মল্লবর্মণ খুব বড় লেখক। এটা সে জানে কিন্তু তাদের স্কুলে তাঁকে নিয়ে কখনো কোনো অনুষ্ঠান হয় না।
দারিদ্র্য আর অশিক্ষার মতো বড় দুই মানবিক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করছে তিতাসপাড়ের মালো সম্প্রদায়। অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি শুরু হয়েছে এভাবে, 'তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।' কিন্তু তিতাসপাড়ের মালোরা যে স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দিনযাপন করছে তা দেখার যেন কেউ নেই।মু স্তা ফা জা মা ন আ ব্বা সী
কবির পথ ধরে বহুবার ঘুরেছেন তার বর্ণিত জগতে, গিয়েছেন পদ্মা, যমুনা, ইছামতি, বড়াল, করতোয়া, আত্রাই, চলনবিল, শাহজাদপুর, শিলাইদহ, পতিসর ও শত জনপদের গহনে। স্থিরচিত্র প্রথমে স্কেচ করেছেন, তারপর ক্যামেরায় বন্দি করেছেন 'ছিন্নপত্রে'র মহার্ঘ চরণগুলো। পদ্মাবক্ষে পালতোলা বজরা, দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে বিস্তীর্ণ পানির আহ্বান। দূরে দেখা যায় নিস্তব্ধ কোলাহলের মধ্যে প্রভাত সন্ধ্যা। দুরন্ত বালক তার ছাগ শিশুটিকে 'সিলহুয়েটে'র মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নদীর পাড় ঘেঁষে। আসল ধন কী, স্বর্গ কী বুঝতে হলে যেতে হয় নদী তীরে, ফুটে আছে যেখানে জীবন্ত শর্ষে ফুলের মধ্যে বিকশিত হলুদ আর পসরা নিয়ে চলেছে সলাজ গ্রামীণ মুখশ্রী সরু আলপথ ধরে
লেখককে যেতে হবে নদীতীরে। সেখানে যেন নিজেকে চিনতে পারি। অবিস্মরণীয় মুহূর্ত কেটেছে নদীতীরে। সুন্দর সে নদীর নাম, সুন্দর সে নদীর তীর। পদ্মা, মেঘনা, সুরমা, যমুনা, ডাকাতিয়া, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, আড়িয়াল খাঁ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, খোয়াই, চিত্রা, সুগন্ধা, কর্ণফুলী, মনু, কুশিয়ারা, তিস্তা, তোর্ষা, ইছামতি, গোমতি, কপোতাক্ষ, তিতাস, কালজানিসহ কয়েকটির নাম করলাম। প্রতি নদী নিয়ে বয়ে চলতে পারে আরেক লেখার বহতা। আমার লেখা নতুন উপন্যাস 'নদী উপনদী'তে আছে যাদের কথা। বিধাতাও বুঝি নদীতীরের স্বপ্ন দেখান মানুষকে সারা গ্রন্থজুড়ে। বিটিভির 'ভরা নদীর বাঁকে'তে নদীতীর ঘুরে এসেছেন নতুনরা। অধমের সঙ্গে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, মুর্শিদি, বাউলের আবর্তে। লোকসংস্কৃতির পরিচয়বাহী অনুষ্ঠান টোলের শিক্ষকের মতো দীর্ঘদিন চালিয়ে গেছি। নদী তীর সম্ভার অন্তরঙ্গই নয়, হয় অস্তিত্বের অঙ্গীভূত। শৈশব-কৈশোর-যৌবন-ভাটি জীবনের মহার্ঘ সওদা প্রস্তুত করে জলরাশি-কাদামাটি-মাঠঘাট-আকাশের মেঘ। কাশবনে সঙ্গে ছিলেন বিটিভির মুসা আহমেদ, আলী ইমাম ও আরও অনেক প্রডিউসার। শত কলাকুশলী নিয়ে উপস্থিত ছিলেন পল্লীবাংলার কয়েকশ' শিল্পী। এখন স্মৃতির শ্যাওলায় সবুজ।
নতুন প্রজন্মের জন্য এ লেখা, বড়দের জন্য নয়। তারা অনেক কিছু দেখে ফেলেছেন। কিছু সুজনের মতো হলো, যে উপন্যাসগুলো পঠিত সেগুলো বহুলালোচিতও বটে। সেগুলো তাকে তুলে রাখা হোক। ভ্রান্তি এখানেই। প্রতি সফল উপন্যাস বারবার পাঠ করার অবকাশ রাখে, প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনার। আমেরিকায় স্কুলে গিয়ে আমার চোখ খুলে যায়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য শিক্ষকদের কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, তা আমি দেখে এসেছি। তাই বলছি, এগুলো নতুন করে অধ্যয়ন করা হোক নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। দেশের নতুন শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে লুকিয়ে আছেন অমিত সম্ভাবনার রবিঠাকুর, নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কেমন করে হবে তাদের দৃষ্টিপাত 'শ্যামলে সবুজে নীলিমায় নীল' প্রকৃতির পানে। যারা নদীকে হৃদয় দিয়ে অবলোকন করেছেন তাদের করতে হবে আপন। কয়েকটি গ্রন্থের দিকে দৃষ্টিপাতের জন্য আমার এ আহ্বান। বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। আজ মাত্র ছ'টি।
তিতাস একটি নদীর নাম [১৯৫৬] : অদ্বৈত মল্লবর্মণ [১৯১৪-১৯৫১]
বাংলাভাষার বলিষ্ঠ কালজয়ী কথাসাহিত্যিকের লেখা, মহান শিল্পী উৎপল দত্ত ও ঋতি্বক কুমার ঘটকের পরিচালনায় যার অসামান্য উপন্যাস অবলম্বনে নাটক মিনার্ভায় অভিনীত হয় শতরজনী। ফিরে আসি 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে ও 'অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্রে', সংগৃহীত ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ আলোচনা চিঠিপত্রে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস তীরে মালোপাড়ায় সারাদিন। ভরা নদীর বাঁকে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মালোদের পাড়ায় খুঁজে পাই তার বসতবাটি, চারপাশে জেলেদের শুকাতে দেওয়া মাছের জালগুলো আর তার ভাইয়ের ফেলে যাওয়া অসংখ্য প্রাচীন লোকসঙ্গীতের উপাদান। ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটিতে লাখো বইয়ের মধ্যে খুঁজে পাই তার অমরগ্রন্থ ও তৎসঙ্গে ইংরেজি অনুবাদ। চিনলাম অদ্বৈতকে, লোকসঙ্গীতের অন্তরঙ্গ সাথী।
হিরামন মঞ্জিলে পিতা আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সম্ভবত 'মোহাম্মদী'তে কাজ করতেন। গ্রন্থটি বাঙালি মনোরাজ্যের প্রামাণ্য দলিল। যিনি স্পর্শ করবেন, জানবেন তিতাসের ঢেউ কি প্রবল, মৎস্য শিকারি মালোদের জালে লুকিয়ে আছে কত স্বর্ণালি উপাখ্যান, কত স্বপ্ন, কত সঙ্গীত। অদ্বৈত তিনি, যিনি বাংলার অমর লোকসঙ্গীতকে টেনে এনেছেন তার উপন্যাসে। অন্যরাও নমস্য, তবু বলতে হয়, অন্যদের লেখনীতে তা দূরাগত বংশীধ্বনি। নতুন লিখবেন যারা, যেন এ দিকটি খেয়াল রাখেন।
'পদ্মা নদীর মাঝি' [১৯৩৬] : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় [১৯০৮-১৯৫৬]
উপন্যাসটি পড়ার জন্য লেখকদের প্রতি আহ্বান। ডাক নাম মানিক, পোশাকি নাম : প্রবোধ কুমার। সান্নালের সঙ্গে দূরবর্তী হওয়ার মানসে ডাক নামের ব্যবহার। পাই নদীর মোহনা, ছোট দ্বীপগুলো, প্রেম-অপ্রেমের সংগ্রামে জীবনের জটিলতা। ঝড়-ঝঞ্ঝা-বাও-বাতাস, প্রকৃতির রূপবদল, সবুজ-শ্যামলিমা নির্মিত ছায়াছবির মধ্যে যেমন প্রতি দৃশ্যে, উপন্যাসে তেমনটি নয়। কপিলা, কুবের, হোসেন, মেজ বাবু, গোপী, বিপীন, গণেশ, আমিনুদ্দিন চরিত্র সজীব, নৌকার মধ্যে 'সাতজন মুসলমান মাঝি'র অবস্থান নতুন পাঠককে চমকে দেবে। ওরা কি তবে অন্য গ্রহের লোক?
'নদীর বিদ্রোহ' গল্পে খুঁজে পাই নদীকে
'নদীর ধারে তার জন্ম হইয়াছে, নদীর ধারে সে মানুষ হইয়াছে, চিরদিন সে নদীকে ভালোবাসিয়াছে। দেশের নদীটি তার হয়তো এই নদীর মতো এতবড় ছিল না, কিন্তু শৈশব, কৈশোর আর প্রথম যৌবনে বড়-ছোটর হিসাব কে রাখে?'
নদীগুলো বারবার ফিরে এসেছে। বিক্রমপুরের মালপদিয়া তার স্বগ্রাম।
'তিস্তা পারের বৃত্তান্ত' [১৯৮৮] : দেবেশ রায় [১৯৬১-]
'দেবেশ রায়ের তিস্তা পারের বৃত্তান্ত পেঁৗছেছে কি'? প্রখ্যাত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর ছেলে উৎপলেন্দুও ভালো গায়। কলকাতার নতুন 'মল'-এ বইয়ের দোকানে পেলাম ৫০৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থ। পরিচিত হই গয়ানাথের জোতজমি, বাঘারুর নির্বাসন, নিতাইদের বাস্তুত্যাগ ও সীমান্ত বাহিনীর সীমান্ত ত্যাগ, উত্তরখণ্ডের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র দাবির সঙ্গে।
কালিম্পং থেকে নেমে এসেছে তিস্তা, গজালডোবা, আপলচাঁদ ফরেস্ট, ক্রান্তিহাট, চ্যাংমারিহাট, জলপাইগুড়িসহ ধরমপুর পার হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের সীমান্তে। ভুটান থেকে নেমে নাগরাকাটা, ধূপগুড়ি হয়ে জলঢাকা নদী। পূর্ব ভুটান থেকে নেমে এসেছে তোর্ষা, মাদারিহাট হয়ে স্বগ্রাম বলরামপুরে এসে নাম, কালজানি, শৈশব-কৈশোরের রোমান্স দিয়ে প্রস্তুত অনন্য জলস্রোত, জীবন নদীর উজানেতে যার কথা। রাজনীতি সম্পৃক্ত উপন্যাস, বন্যায় উদ্বাস্তু নমঃশূদ্র চাষি, চরভাঙ্গায় বিধ্বস্ত লুঙ্গি পরা আজিজ, মেখলিগঞ্জ, হলদেবাড়ির ছিটমহলে উঠে এসেছে উপাখ্যান, পাঠককে করে সমৃদ্ধ।
দেবেশ রায় সম্ভবত পূর্ববঙ্গ থেকে আগত, উত্তরাঞ্চলের মনন রাতারাতি তার হবে না, এটিই স্বাভাবিক। ওই মাটিতে বড় যারা, পার্থক্যটি অনুধাবন করতে পারি। পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা ভাওয়াইয়া গায়ক ড. সুখবিলাস বর্মা, বললেন, সবই আছে, নেই উত্তরবাংলা। নদী-মানুষ-রাজনীতি সাধারণ মানুষকে কীভাবে জাগায়, কীভাবে তলায় তার কথা সুন্দরভাবে লেখা। নেই উত্তরের সংস্কৃতি : ভাওয়াইয়া-চটকা-ক্ষিরোল-পালাগান-বৈরাতি-রাজবংশী-মেচরাভা-চা বাগান।
উত্তরবঙ্গেই আছে এমন বন, যার তলে দিনের আলো পেঁৗছে না, এ মাটিতেই কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুদয় পূর্ববাংলা থেকে ভিটে হারানো হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে, করতোয়া নদী দেবীর করধোয়া, 'জলপাইগুড়ি, শীতবুড়ি শুয়ে থাকে দিয়ে লেপমুড়ি'। এতদ্সত্ত্বেও, তিস্তার উলেল্গখযোগ্য দলিল এটি। উত্তরবাংলা নিয়ে লিখলে অনুরোধ করব লোকসংস্কৃতির গভীর অধ্যয়ন।
'কাশবনের কন্যা' [১৯৫৪] : শামসুদ্দিন আবুল কালাম [১৯২৬-১৯৯৭]
শামসুদ্দিন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা আমার পড়া প্রথম উপন্যাস। বায়ান্ন থেকে চুয়ান্ন_ তিনি প্রায়ই আসতেন পুরানা পল্টনে আমাদের বাড়িতে। তার দীর্ঘ সুশ্রী অবয়ব, মিষ্টি করে কথা বলা আকৃষ্ট করত। কামরুল হাসানের স্কেচ ও লোকবৃত্তের শ্রেষ্ঠ গানের উদ্ধৃতি সুশোভিত কাশবনের কন্যাকে কি সুমধুর ব্যঞ্জনায় করেছিল মুখরিত।
শামসুদ্দিন আবুল কালামকে ভালো লাগার কারণ, এই কাশবনেই তার চয়ন করা রাজকন্যা প্রেম সুধায় মাটির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন পাঠকদের। শামসুদ্দিন দেশ ছেড়েছিলেন, কাশবনের আড়ালে রমণীর সুমধুর প্রেমের স্মৃতিকে নয়। রমণীর প্রেমই নদী তীরের সম্পদ।
দীর্ঘদিন পর তাকে চিঠি লিখি, যখন তিনি রোমে। লিখলাম, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস এটি, এর চলচ্চিত্রায়নে আমি আগ্রহী। কয়েকটি চিঠি লেখেন, উঁইপোকায় তা ভক্ষণ করেছে। লিখেছেন : নদী তীর চোখের প্রথম দৃষ্টি, ওইটি যেন হয় শেষ। ছবি করা হয়নি।
'পদ্মার পলিদ্বীপ' :আবু ইসহাক
'সূর্যদীঘল বাড়ি'র আবু ইসহাক। পদ্মার পলিদ্বীপ-এ বর্ণিত অনেক গ্রাম। যে গ্রামগুলো আমাদের এত আপন। আশ্রয় করে নিয়েছে আবু ইসহাকের স্বগ্রাম শিরঙ্গম, শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার অন্তর্গত ঘুমিয়ে থাকা গ্রাম, আজও।
আমারও আছে গল্প। পাশের গ্রামেই কাটিয়েছি পনের দিন, ভয়ঙ্কর ঝড়ে যেখানে উড়ে গিয়েছিল গ্রামের সব ঘরবাড়ি, প্রাণ হারিয়েছিল শত শত মানুষ। সালটি ছিয়াশি। দেড়শ' ঘর বানিয়ে দিয়েছিলাম দাঁড়িয়ে থেকে সহযাত্রী নুরুদ্দিন তওফিক-উল-ইসলামের সঙ্গে। চরমপন্থির একজন হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে আমাকে পেটের মধ্যে রিভলবার ঢুকিয়ে প্রশ্ন করলেন : এখানে কী কাজ? উত্তর দিলাম : অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছি, ঘর বানিয়ে দিচ্ছি, দেখতে পাও না? চোখে আমার অশ্রুবিন্দু, ভয়ে নীল। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ শত অকৃত্রিম চিত্র, দ্বন্দ্ব-কলহ, সমাজের নানা স্তরে অজগর পদ্মার কীর্তি বিনাশী কর্মপ্রবাহ যদি তোমার জীবনের স্টোরির সঙ্গে জড়িয়ে নিতে চাও, বইটি পড়লেই পথ খুঁজে পাবে। যাকে চেনই না, তাকে নিয়ে কী লিখবে? যে গান শোননি, সে গান তোমার নয়। পঠিতব্য অশোক বিশ্বাসের 'নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পদ্মার পলিদ্বীপ' [কালি ও কলম : সপ্তম বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, ১৪১৭]।
'ছিন্নপত্র' [আলোকচিত্র] [২০০২] : ড. নওয়াজেশ আহমেদ [১৯৩৭-২০০৯] [রবীন্দ্রনাথের 'ছিন্নপত্র' অবলম্বনে আলোকচিত্র সম্ভার]
'ছিন্নপত্র' আলোকচিত্র। উপন্যাস নয়, গল্পও নয়। ড. নওয়াজেশ আহমেদ সমবয়সী। বললাম, এ কি অসাধারণ কাজ আপনার, বইমেলার পর কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের এক অভ্যর্থনা সভায়। জানালাম, রবীন্দ্রনাথকে কত গভীরভাবে স্পর্শ করে তার চোখ দিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন নদী তীরে দীর্ঘদিন, সঙ্গে দোসর ক্যামেরা।
জিজ্ঞেস করলেন, কোন ছবিগুলো আপনার মনে দাগ কেটেছে।
বললাম : প্রতিটি। কবির পথ ধরে বহুবার ঘুরেছেন তার বর্ণিত জগতে, গিয়েছেন পদ্মা, যমুনা, ইছামতি, বড়াল, করতোয়া, আত্রাই, চলনবিল, শাহজাদপুর, শিলাইদহ, পতিসর ও শত জনপদের গহনে। স্থিরচিত্র প্রথমে স্কেচ করেছেন, তারপর ক্যামেরায় বন্দি করেছেন 'ছিন্নপত্রে'র মহার্ঘ চরণগুলো। পদ্মাবক্ষে পালতোলা বজরা, দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে বিস্তীর্ণ পানির আহ্বান। দূরে দেখা যায় নিস্তব্ধ কোলাহলের মধ্যে প্রভাত সন্ধ্যা। দুরন্ত বালক তার ছাগ শিশুটিকে 'সিলহুয়েটে'র মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নদীর পাড় ঘেঁষে। আসল ধন কী, স্বর্গ কী বুঝতে হলে যেতে হয় নদী তীরে, ফুটে আছে যেখানে জীবন্ত শর্ষে ফুলের মধ্যে বিকশিত হলুদ আর পসরা নিয়ে চলেছে সলাজ গ্রামীণ মুখশ্রী সরু আলপথ ধরে। আপনি উপলব্ধি করেছেন শস্যক্ষেত্রের কাটাকাটা বিন্যাস, যেখানে গরুর মুখে জোয়াল দিয়ে হাল বইছেন হাড়জীর্ণ কৃষক, একই ছবিতে বপন করছেন শস্য তার স্ত্রী ও পুত্র। চিত্রটি মনে গাঁথা হলেই বোঝা সম্ভব হবে কৃষকের কষ্ট ও অনুভূতি। কত কষ্টে কত ধান, কত ধানে কত চাল, কত চালে কত ভাত।
কথা বলছিলাম, আর নওয়াজেশ প্রায় কেঁদে ফেলেন।
১৫২ পৃষ্ঠার বইটি খুলে পড়ি। পড়ি, রবিবাবুর 'ছিন্নপত্র'...। 'আবার সেই বালিকাটিকে সেই গরাদের জানলার সম্মুখে দেখা যাইতেছে এবং ঘরের মধ্যে সেই যুবাপুরুষটি বসিয়া আছে। আকাশে মেঘ-রোদ্রের খেলা যেমন সামান্য, ধরাপ্রান্তে এই দুটি প্রাণীর খেলাও তেমনি সামান্য, তেমনি ক্ষণস্থায়ী।'
ছবি আঁকতে পারে অনেকটাই। গান মূর্ত করতে পারে আরও খানিকটা। ধারণ করার ক্ষমতা শুধু লেখনীর।
নিজ দর্শন ঃ
জানিয়েছি, লিটল ম্যাগাজিন রোটার্যাক্টে যমুনাবক্ষে নিবন্ধে :
প্রমত্ত যমুনায় ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় অধম। ভাটিয়ালির টানে বিভোর আকাশের দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি। মুহূর্তে শীতল বাতাস। কালো মেঘপুঞ্জ ছুটে আসে দৈত্যের মতো ডিঙ্গি নৌকাটিকে গ্রাস করতে। তলিয়ে যাচ্ছি চিরতরে, বিপন্ন অস্তিত্ব বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদ।
মাঝি সাঁতার জানে, আমিও। দু'কূল ছাপানো নদীতে টিকে থাকব মিনিটখানেক। চকিতে পুলসিরাত দেখতে পাই। সরু পুলটি, হেঁটে চলেছে লাখ লাখ দিগ্গি্বদিক শূন্য মানুষ। প্রতিকূলতায় ছিটকে পড়ছে মানুষ নদীর দু'ধারে।
মেঘবজ্র হুঙ্কার ও বাতাসের শন শনের মধ্যে জীবন-মৃত্যু।তিতাস নদী
তিতাশ চৌধুরীতিতাস নদীর বয়স একেবারে অল্প নয়। এই নদী তার দুই তীরের মানুষের উপকার সাধন করেছে। কৃষকের কৃষি উত্পাদনে বিপুল সহায়তা করেছে। এই নদীকে কেন্দ্র করে ইতিহাস-ঐতিহ্য নির্মিত হয়েছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাসের তীরের ধীবর শ্রেণীর মানুষের জীবন-যাত্রা নিয়ে লিখেছেন 'তিতাস একটি নদীর নাম' শীর্ষক একটি কালজয়ী উপন্যাস। এখানে লেখকের নদীকে দেখার রহংরমযঃ অত্যন্ত গভীর। সে কারণেই উপন্যাসের চরিত্রগুলো কমবেশি সবাইকে বিপুল আকর্ষণ করেছে। এই যে নদী—আজ আর তার আগের রূপ-ঐশ্বর্য নেই। তিতাস বর্তমানে ক্ষীণকায় নদীতে পরিণত হয়েছে। একদিন যেখানে তিতাস ছিল যৌবনবতী এবং যে তিতাসে একদিন স্টিমার ভেসে বেড়াত— আখাউড়া, গোকর্ণঘাট, আমিনপুর প্রভৃতি স্থান স্পর্শ করত, আজ সেখানে চর পড়েছে। গোকর্ণঘাট থেকে নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর প্রভৃতি স্থানে ছোট ছোট লঞ্চের সহজ যাতায়াত এখনও জিইয়ে আছে। তাহলে হবে কী, নদীর নাব্য না থাকায়, যৌবন না থাকায় তার গতিপথের অনেক স্থানেই কৃষি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে নদীর তীরের বিপুল সংখ্যক মানুষের পানির তীব্র অভাব হচ্ছে। সম্প্রতি প্রথম আলোর এক রিপোর্টে জানা যায়, 'ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগর উপজেলা এবং কুমিল্লার হোমনা উপজেলার সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত তিতাস নদী মরে যাচ্ছে ক্রমেই। পলি জমে কমে আসছে নদীর গভীরতা। অনেকে নদীর উভয় তীর ভরাট করে বোরো চাষের জমি তৈরি করছেন। কেউ কেউ বানাচ্ছেন মাছের ঘের। এতে এক সময়ের খরস্রোতা এই নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে নদী সংলগ্ন খাল। এর বিরূপ প্রভাবে তীরবতী বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা দিয়েছে সেচ সঙ্কট। তিতাস মেঘনা থেকে উত্পন্ন হয়ে আবার মেঘনায় গিয়ে পড়েছে। এই নদীটি ইংরেজি গ (এম)-এর মতো।' রিপোর্টে আরও বলা হয়, 'বাঞ্ছারামপুরের কালিকাপুর এবং হোমনার শ্রীমদ্দি গ্রামের সীমানা দিয়ে মেঘনা নদী থেকে তিতাস নদী শুরু হয়েছে। প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ঘাগুটিয়া লঞ্চঘাট এলাকায় এসে নদীটি দুটি ভাগে ভাগ হয়েছে। একটি অংশ বাঞ্ছারামপুরের ওপর দিয়ে পাইকারচর, আসাদনগর খাপ্পা হয়ে আবার মেঘনা নদীতে মিশেছে। অপর অংশ ভুরভরিয়া, গঙ্গানগর, নতুন ইমামনগর, নবীনগর উপজেলার বিটিবিশারা ধরাভাঙ্গা গ্রাম হয়ে মেঘনা নদীতে পড়েছে। হোমনার পশ্চিম অঞ্চল থেকে পূর্বদিকে শ্রীমদ্দি, হোমনা সদর, রামচন্দ্রপুর দিয়ে সরু হয়ে গেছে। প্রায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ তিতাস নদীতে অর্ধশতাধিক সংযোগ খাল রয়েছে। এসব খালের পানি দিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি একর জমিতে বোরো চাষ করেন এলাকার কয়েক হাজার কৃষক' (তিতাসের কান্না, ৫ এপ্রিল ২০১০)। বর্তমানে নদী তীরের কিছু মানুষের কারণে নদীটি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, এর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে কৃষিকাজের ব্যাপক অসুবিধা দেখা দিচ্ছে। যারা জমি করার জন্য নদী দখল করছে, যারা মাছ চাষের জন্য ঘের বানাচ্ছে—তারা গুটিকতক। এ গুটিকতক মানুষই বিপুল মানুষের ক্ষতিসাধন করছে। এ ব্যাপারে আশু ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
তিতাস নদী এককালে ইতিহাস নির্মাণ করেছে, সভ্যতা ও ঐতিহ্য নির্মাণ করেছে। কবি-সাহিত্যিকরা তিতাসের রূপ-ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়েছে এবং একে নিয়ে নানা কাহিনী, গল্প, কবিতা, ছড়া ও উপন্যাস রচনা করেছে। তিতাস নদীর অমলধবল রূপ, এর চঞ্চল ও ডানপিটেপনা দুই তীরের মানুষকে কলমুখর, কখনও ভীত করেছে। আজ তিতাস নদীর ভিন্ন রূপ দেখে সাংবাদিকরা এর প্রতিকারকল্পে রিপোর্ট তৈরি করছেন, কবিরা লিখছেন এর সম্পর্কে ভিন্ন কবিতা, গল্প ও কাহিনী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট থেকে নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর প্রভৃতি স্থানে আজকাল অনেকেই প্রয়োজনের তাগিদে লঞ্চে যাতায়াত করেন। সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। অথচ গোকর্ণঘাট থেকে নবীনগর লঞ্চে না গিয়ে স্থলপথে বাসে কিংবা মোটরকারে গেলে ১৫/২০ মিনিটের অধিক সময় লাগত বলে মনে হয় না। আজ এত বছর হয়ে গেল তিতাস নদীর ওপর দিয়ে ছোট একটি বেইলি ব্রিজ তৈরি হলো না! এটিও তিতাস তীরের মানুষের একটি দুর্ভাগ্য। কবে হবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-নবীনগর স্থলপথ?
অপ্রাকৃতিক কারণে আজ যারা তিতাসের রূপশ্রী হরণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অন্যদিকে তিতাসের পূর্বঐতিহ্য, ইতিহাস ও সভ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য এর ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন আছে। তিতাসের জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও দরকার। তিতাসের রূপচাঞ্চল্য বর্ষায় যারা অবলোকন করেননি, তারা এর রূপ-গরিমা সম্পর্কে অল্পই ধারণা করতে পারেন।
আমি তিতাসপাড়ের মানুষ। তিতাস ছিল আমার শৈশব ও কৈশোরের নদী। যৌবনবতী তিতাসে যে আমি কতবার সাঁতার কেটেছি, স্নান সেরেছি—আজ আর তা বলতে পারব না। তিতাসকে ভালোবেসেই আমি বড় হয়েছি। শৈশব-কৈশোরে তিতাস ছিল আমার আনন্দ-উল্লাস আর উচ্ছ্বাস প্রকাশের নদী। আজ দূর থেকে তিতাসের কান্না শুনে বিচলিত, বিহ্বল ও উদ্বেলিত হই। চকিতে চমকিত হই। তিতাসের আজ এ কী রূপ! তিতাস, তুমি আজ কোন্ কথা কও?
লেখক : কবি-গবেষক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও অলক্ত সম্পাদকজন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫
জন্মস্থান : ঢাকা
মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬
মৃত্যুস্থান : কলকাতা।
ঋতি্বক ঘটক বা ঋতি্বক কুমার ঘটক বিখ্যাত বাঙালি চিত্র পরিচালক। তার মায়ের নাম ইন্দুবালা দেবী এবং বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক। তিনি বাবা মায়ের ১১তম এবং কনিষ্ঠতম সন্তান। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগের পরে পূর্ববঙ্গের বহু লোক কলকাতায় আশ্রয় নেয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। শরণার্থীদের অস্তিত্বের সঙ্কট তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে এবং পরবর্তী জীবনে তার চলচ্চিত্রে এর প্রভাব পড়ে।
চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল (১৯৫০) সিনেমার মধ্য দিয়ে। এর দু'বছর পর তার একক পরিচালনায় মুক্তি পায় নাগরিক। উলি্লখিত দু'টি চলচ্চিত্রই ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারাকে ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হয়েছিল।
তার সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২) অন্যতম; এ তিনটি চলচ্চিত্রকে ট্রিলাজ বা ত্রয়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তিতাস একটি নদীর নাম তার পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত বাংলা সাহিত্যের একটি বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে ঋতি্বক ঘটকের পরিচালনায় চলচ্চিত্রে রূপদান সম্পন্ন হয়। খারাপ স্বাস্থ্য এবং অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে নিয়মিত কাজ চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে তিনি সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে তুলনীয়।
ঋতি্বক ঘটক এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং তিনি কবিতা ও নাটক লিখতেন। ঋতি্বকের বড় ভাই সে সময়ের খ্যাতিমান এবং ব্যতিক্রমী লেখক মনীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী। ওচঞঅ থিয়েটার মুভমেন্ট এবং তেভাগা আন্দোলনে মনীশ ঘটক জড়িত ছিলেন। মনীশ ঘটকের মেয়ে বিখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী। ঋতি্বক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। ঋতি্বক ১৯৬৬ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনেতে বসবাস করেন। এ সময় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে (ঋঞওও) অধ্যাপনা করেন।হুমায়ুন আহমেদ0%গড় রেটিং:রেটিং :তারুণ্যের ৬৩ বছরসুচিপত্র0%গড় রেটিং:রেটিং :প্রচ্ছদ রচনা
গল্পের রাজা, বর্ণনার রাজা
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ৪
বড় ভাইয়ের জন্মদিন এবং...
আহসান হাবীব ৮
এসএসসি পরীক্ষা
মমতাজ শহীদ ১০
বড় মামা
অপলা হায়দার ১২
বিশেষ রচনা
লেখক যাবে নদীর সন্ধানে
মুস্তাফা জামান আব্বাসী ১৩
কবিতা
ফারুক মাহমুদ, জাহিদ হায়দার
জুয়েল মজহার, টোকন ঠাকুর
মামুন খান ১৬-১৭
গল্প
দদ্রু বিনাশের পুতুলবউ
সালেহা চৌধুরী ১৮
শেষ ভোজ
তুষার কণা খোন্দকার ২২
চলচ্চিত্র
ডুবসাঁতার ও অন্যতর
আলোর অপেরা ২৫
ফিচার
বৃহদেশ্বরা মন্দির ২৭
বইপত্র
২৯
শেষ পাতা
বাঙালি মধ্যবিত্তের বর্জনপ্রীতি
সিরাজুল ইসলাম চৌধুী ৩০লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের সন্ধানে0%গড় রেটিং:রেটিং :কালের খেয়া নিয়মিত পড়ি একেবারে শুরু থেকেই। সময়ের সঙ্গে কালের খেয়ার বড় ধরনের একটা বাঁকবদল হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে এর ঐশ্বর্য ও জৌলুস বেড়েছে, এতটুকুও কমেনি। ৫ নভেম্বরের সংখ্যা পড়ে আরও একবার সে কথাই মনে হলো। তাই ধন্যবাদ জানানোর জন্য কলম হাতে না নিয়ে পারলাম না।
পালকি, নৌকা আর গরুর গাড়ি_ প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এই তনি জিনিস নিয়ে রচিত তিনটি রচনাই অপূর্ব। বিষয়গুলো নিয়ে যাদের একেবারে জানা নেই, তাদের মনেও দাগ কাটবে রচনাগুলো। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের যে ঐতিহ্য ধীরে ধীরে সভ্যতার বিবর্তনে আমাদের সামনে থেকে অপস্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। তার স্মৃতিচারণ একই সঙ্গে যেমনি স্মৃতিকাতর করে তোলে, তেমনি গৌরবময় ঐতিহ্যের জন্য গর্বিতও করে। বাস্তবিকই, বিজ্ঞান ও আধুনিক সভ্যতা আমাদের জীবনে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এই তিনটি উপাদানই আমাদের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের লোকগান, পুঁথি, যাত্রাপালায় এদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। গত দুই দশকে নদীপথের সংকোচন এবং ছোট-বড় অনেক সেতু নির্মাণের ফলে নৌকার ব্যবহার অনেক কমে গেছে। খোদ উত্তরাঞ্চলেও আজকাল গরুর গাড়ি দেখা যায় না। পালকির প্রচলন তো বিলুপ্তই হয়ে গেছে। আমরা যদি এভাবে আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী যানগুলোর কথা ভুলেই যাই তবে সংস্কৃতির বড় উপাদান হারাব। শিকড় পরিত্যাগ করলে যেমন গাছ বাঁচতে পারে না, তেমনি এসব উপাদানকে হারিয়ে যেতে দিলে আমাদের সংস্কৃতির মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্যও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। বর্তমান পৃথিবীতে বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যুগে আমাদের জন্য যা হবে দুর্ভাগ্যজনক। তাই বাস্তবতার নিরিখে ক্রমঅগ্রসর আধুনিক সভ্যতার ভিড়ে এদের সহজলভ্য ঠাঁই না হলেও যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে টিকিয়ে রাখার। নয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো ভুলেই যাবে একসময়ের বহুল ব্যবহৃত এসব যানের কথা।
বেশ কিছুদিন আগে জাতীয় জাদুঘরে ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশ আয়োজিত এক নৌকা প্রদর্শনী দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দেখছিলাম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নৌকার সংখ্যাই বেশি। ভাবতে অবাক লাগছিল এত সমৃদ্ধ নৌকাশিল্পের কথা অজানাই থেকে যেত, যদি না নৌকার কারিগর আর কারুশিল্পীদের সহায়তায় এসব নৌকার মডেল তৈরি করা সম্ভব হতো। এসব কারুশিল্পী তাদের পেশা থেকে আজ প্রায় বিচ্যুত। বড় জোড় ছোটখাটো কোষা নির্মাণ করতে করতে অন্য নৌকার অবয়ব হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মন থেকে। বেহারা আর গাড়োয়ানরা ছেড়ে দিচ্ছেন তাদের বংশানুক্রমিক পেশা। নৌকার বেলায় সংরক্ষণ সম্ভব হলেও কে ভাববে পালকি আর গরুর গাড়ি নিয়ে? কত বিচিত্র ধরনের নকশা ছিল এই যানগুলোর, তা জানার উপায় এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে।
এই মনে করিয়ে দেওয়ার কাজটি করার জন্য কালের খেয়াকে আরেকবার ধন্যবাদ। যারা লিখেছেন তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। ভবিষ্যতেও কালের খেয়ার কাছে এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী উপাদান সম্পর্কে সুখপাঠ্য রচনা আশা করি।
মাহমুদুল হক
গেণ্ডারিয়া, ঢাকাগল্পের রাজা, বর্ণনার রাজা0%গড় রেটিং:রেটিং :সৈ য় দ ম ন জু রু ল ই স লা মহুমায়ূন আহমেদ, ঁজন্ম ১২ নভেম্বর ১৯৪৮
হুমায়ূন আহমেদের প্রথমদিকের কয়েকটি উপন্যাস নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার ইত্যাদি পড়ে তার মুগ্ধ পাঠকে পরিণত হয়েছিলাম। কিন্তু মাঝখানে বহুদিন তার কোনো উপন্যাস পড়তে পারিনি ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় সময়ের অভাবে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, এই সময়ের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দুতে পেঁৗছে গেছেন_ যদি জনপ্রিয়তাকে এ রকম জ্যামিতিক হিসাবে পরিমাপ করা যায়। বাংলাদেশের পাঠকরা খুব উৎসাহ নিয়ে কখনও বই কেনেনি_ তারা উৎসাহ নিয়ে 'বই' দেখেছে, ছোটবেলা স্কুল পালিয়ে আমিও উত্তম-সুচিত্রার বই দেখতাম। সেই পাঠক যখন হুমায়ূন আহমেদের একটি বই বেরুতে না বেরুতে কিনে শেষ করে ফেলেছে, তখন তার আদি পাঠকদের একজন হয়ে আমার কাছে বিষয়টি প্রীতিকর মনে হয়েছে। তার পাঠকদের একটি বড় অংশ তরুণ ও তরুণী। তাদের কাছে তার উপন্যাসগুলো খুবই প্রিয়, তিনি তাদের স্পর্শ করছেন_ এটিই বড় কথা।
একজন লেখককে যখন চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হয়, তখন তার বিষয়ে একটি অধিকার থাকতে হয়_ সে অধিকার আসে দীর্ঘদিন তার কাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা থেকে, তার কাজের নিবিষ্ট পঠনপাঠন থেকে। ওই একাডেমিক চর্চার অভাব থাকে তাদের ক্ষেত্রে, যারা পাঠ্যকার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকেন না। অর্থাৎ যারা শ্রেণীকক্ষে পঠিত হন না, যাদের নিয়ে গবেষণা করা হয় না। যারা কম লেখেন তাদের না হয়, অন্তত লেখাগুলোর সব পড়া যায়; যারা অতিপ্রজ, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা থেকেই যায়।
সম্প্রতি হুমায়ূন আহমেদ একটি সাক্ষাৎকার বলেছেন, হাঁড়ির একটি ভাত যেমন পরখ করে বলে দেওয়া যায় সব ভাতের খবর, সে রকম তারও একটা বই পড়ে তার সম্পর্কে মন্তব্য করা চলে, কারণ তিনি 'রাঁধুনি ভালো'। এতে আশ্বস্ত হয়ে তার সম্পর্কে দু-তিনটি কথা লিখতে বসেছি। অবশ্য ইতিমধ্যে তার গল্পসমগ্র তিনি আমাকে উপহার দিয়েছেন এবং গল্পগুলোকে গভীরভাবে নাড়া দেওয়ায় ওই হাঁড়ির খবর অনুমান করার কাজটি কিছুটা স্বস্তিকর হয়েছে।
তবে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে একটি ঘটনার উল্লেখ করে প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। নন্দিত নরকে ইত্যাদি বই লিখে তিনি মাঝখানে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ চলে যান। ফিরে আসার পর যখন লেখালেখি শুরু করেন, বাংলাদেশের বইয়ের বাজার, বিশেষ করে গল্প-উপন্যাসের, তখন পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের দখলে। এটি আমাদের জন্য শ্লাঘার বিষয় হতে পারে না। বিশেষ করে এদের মধ্যে এমন লেখকও ছিলেন, যাদের লেখায় না ছিল কোনো শিল্প, না কোনো নতুনত্ব। একদা এক বাঘের গলায় ধরনের সব গল্প; কিন্তু পাঠকের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। আমাদের দেশে যাকে সিরিয়াস সাহিত্য বলা হয়, তার পাঠক সবসময় সীমিত; কিন্তু ফিকশনের যে পাঠক আছে, সেটি প্রমাণিত হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, এমনকি নিমাই বসুর গল্প-উপন্যাসের কাটতি দেখে। হুমায়ূন আহমেদ এই পাঠকশ্রেণীকে ধীরে ধীরে ফিরিয়ে এনেছে তার দিকে। আজকে তার উপন্যাস ছাড়াও ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের এদের বইও যে মানুষ আগ্রহ নিয়ে কিনছে। শওকত ওসমান, শওকত আলী বা সেলিনা হোসেন, যাদের লেখা আগেও পাঠক কিনত, তাদেরও বিক্রি বেড়েছে। হুমায়ূন আহমেদ যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে লিখে যাচ্ছিলেন, সেটি একদিনে অর্জিত হয়নি, তার জন্য সময় লেগেছে। ১৯৮৪-এর মে মাস, আমার মতে, তার আত্মবিশ্বাসের একটি উঁচু সিঁড়ি অতিক্রমের, আমি সাক্ষী ছিলাম। তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আমার দেখা, খুব যে পরিচয় ছিল তার সঙ্গে তা নয়। তবে বসে এটা-সেটা আলাপ করার মতো সম্পর্ক ছিল। তার হাতে একটা প্যাকেট ছিল, ওপরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলকাতার ঠিকানা লেখা। আমি তার সঙ্গে তার লেখালেখির বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এক সময় তিনি প্যাকেটটা খুলে দুটি বই বের করলেন_ একটির নাম ছিল সৌরভ, অন্যটির নাম মনে নেই। সে দুটির ভেতরে তিনি 'সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রদ্ধাস্পদেষু' লিখে স্বাক্ষর দিয়ে রেখেছিলেন, তাকে পাঠানোর জন্য। বই দুটি তিনি আমাকে দিলেন 'দেশের একজন'কে পড়ার জন্য। বিষয়টি আমার কাছে প্রতীকী মনে হয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে তিনি নিশ্চয়ই এখনও সমান শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু দেশের একজন পাঠককে তিনি সেদিন শ্রদ্ধা করেছিলেন, নিজের ওপর যে বিশ্বাস তাকে তিনি শ্রদ্ধা করেছিলেন। এ পালাবদলটি তার জন্য খুবই গঠনশীল ছিল। বলা যায়, তিনি নিজেকে একটি উঁচু আসনে বসিয়েছিলেন, যা আসলে তারই প্রাপ্য ছিল এবং তিনি যে সহজে কাউকে সেটা ছেড়ে দেবেন, তার সম্ভাবনা আপাতত নেই।
সৌরভ ও অন্য বইটি আমার বইয়ের আলমারিতে কোথাও আছে নিশ্চয়ই, তবে না থাকলে অবাক হব না। তার বই বাসায় রাখা বিপজ্জনক, মানুষকে চৌর্যবৃত্তিতে তা প্ররোচিত করে। আমার মেজদার মেয়ে চিনুর এক বিরাট সংগ্রহ আছে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের, আমি দেখেছি সে রীতিমতো তা পাহারা দিয়ে রাখে। চিনু চাটগাঁ থাকে। না হলে ভুলে যাওয়া বইয়ের নাম তার কাছ থেকে মুহূর্তের মধ্যে জেনে নিতে পারতাম। চিনু এ বিষয়ে 'রেডি রেফারেন্স'। আমার মাকে সারাজীবন তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়তে দেখেছি; আশাপূর্ণা, মহাশ্বেতা দেবী, বিমল মিত্র, সমরেশ বসু প্রমুখ তার প্রিয়। এবার চাটগাঁ গিয়ে দেখলাম, মা আর চিনু মিলে হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ছেন। চিনু মাকে তার সংগ্রহ থেকে ধার দেয়, আর তার প্রিয় এক বান্ধবীকে। ব্যস।
হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তাকে বোঝার জন্য একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি_ চযবহড়সবহধষ. এ জনপ্রিয়তা অভূতপূর্ব। কিন্তু তার কারণ আছে। টেলিভিশনের জন্য তিনি যে নাটক লিখেছিলেন, বিশেষ করে বড় বা পার্বিক নাটকগুলো, সেগুলোর মাধ্যমে বহু পাঠক তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। আমি কালেভদ্রে টেলিভিশন দেখি, তার পার্বিক নাটকগুলো আমি দেখিনি, তবে খাক নামে একটা নাটক পুরো দেখেছি। আমার মনে হয়েছে, তার নাটক বা উপন্যাস আসলে একই জীবনকে দেখায়, যদিও মাধ্যমগত ভিন্নতার জন্য ভিন্নভাবে তিনি উপন্যাসে বেছে নেন মানুষের অভিজ্ঞতার পরিমণ্ডল_ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনে প্রতিদিন যা ঘটে, মানুষের ছোট ছোট সুখ-দুঃখের কাহিনীগুলো। তবে উপন্যাস বা ছোটগল্পের বিষয়বস্তুটাই প্রধান নয়। সেটি কীভাবে পরিবেশিত হয়, সে গল্পটি বলার ধরন_ এসবও গুরুত্বপূর্ণ। হুমায়ূন আহমেদের প্রধান অবলম্বন সারল্য। তিনি অতিরিক্ত কথা বলেন না, অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা আরোপ করেন না, বিষয়বস্তুকে ভারি করে তোলেন না নিজের চিন্তাভাবনা সেখানে আরোপ করে। তার সারল্যের জন্য তিনি মানুষকে স্পর্শ করেন। আমি দেখেছি, তিনি কৌতুককে মূল্য দেন, কৌতুক জীবনের একটি বড় সম্পদ। মানুষের জীবনে অনেক দুঃখের ঘটনার মাঝখানেও হঠাৎ হালকা বিষয় চলে আসে। এই মিশ্রণ জীবনে হয়, হুমায়ূন আহমেদ তাকে উপন্যাসে এবং নাটকে নিয়ে আসেন। অনেকে বলেন, তিনি টেলিভিশনে জনপ্রিয় না হলে ঔপন্যাসিক হিসেবে জনপ্রিয় হতেন না, এটি বাজে কথা। টেলিভিশনে লেখার বহু আগেই তিনি আমাদের কাছে প্রিয় ছিলেন। তাছাড়া টেলিভিশনে জনপ্রিয়তা অর্জন করা কি খুব সহজ? তার নাটক যদি মানুষকে নাড়া না দিত, তাহলে তিনি জনপ্রিয় হতেন না; আর ওই নাড়া দেওয়ার মধ্যে একজন লেখকের শক্তি লুকিয়ে থাকে। আমরা অবশ্য বলতে পারি, টেলিভিশনের জন্য তার বিক্রি বেড়েছে_ সেটি হতেই পারে, বিদেশে এ রকমটি হয়েছে_ জুরাসিক পার্ক যিনি লিখেছেন, তার এখন সবচেয়ে বড় বাজার; কিন্তু বাজার ধরে রাখার জন্য মেধার প্রয়োজন, সেটিও থাকতে হবে।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পসমগ্র আমি অভিনিবেশ নিয়ে পড়েছি। আমার মনে হয়েছে, তিনি মানুষের মনের অনেক হদিস জানেন, আর সেগুলো আমাদের জানাতে পারেন। ছোট আয়তন গল্পগুলোর ছোটখাটো আয়োজন, কিন্তু কী মর্মস্পর্শী। কয়েকটি গল্প আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে, মনে হয়েছে, নিজের অজান্তে গল্পের জীবনগুলোর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছি। হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প পড়ে আমার আরেকটি উপলব্ধি হয়েছে যে, তিনি দীর্ঘ সময় গল্প বলতে পছন্দ করেন না। তার যা বলার সহজেই বলা হয়ে যায়, অথচ মনের মধ্যে তা গেঁথে যায়। তার ছোটগল্প সে ধরনের রচনা। তিনি উপন্যাস লেখেন ক্ষুদ্রায়তন এ জন্য নয় যে তিনি 'অসহিষ্ণু'। বলা যায়, এই স্বল্প পরিসরেই তিনি তার পরিভ্রমণ সমাপ্ত করেন। চিনুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'তোর কি মনে হয় ছোটগল্প অসম্পূর্ণ থাকে?' সে যা বলল তা অনুবাদ করলে এই দাঁড়ায়_ তার মনে হয় গল্প যেন শেষ হয়েও 'হইল না শেষ'। এটি ছোটগল্পের একটি সংজ্ঞা বটে, ঠাকুরকৃত। কিন্তু আসলে এটি দেখা ও দেখানোর একটি (ফিহা) সমীকরণ। যা দেখানোর তা দেখিয়ে দেওয়ার পরও একটি ছায়া থেকে যায়, একটি ধভঃবৎ রসধমব, যেটি চোখে নিয়ে চিনু ঘুমাতে যায়। আমার বিশ্বাস, কোনো কোনো রাতে সে যে ভাত না খেয়ে শুয়ে পড়ে, সেটি ওই ধভঃবৎ রসধমব- এর আক্রমণে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে গিয়ে গত তিরিশ বছর আমার বয়স খুব বাড়েনি। কারণ, আমার দিন কাটে তারুণ্যের সংস্পর্শে। এ তারুণ্য আমাকে অভিভূত করে। আমার শুধু মনে হয় কত অপচয় হয়, কতভাবে এ তারুণ্যের। যদি তার সবটা কাজে লাগানো যেত! তারুণ্য শঠতা জানে না, জটিলতা জানে না। আমি অবাক হই, হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে এই বিশাল তারুণ্যকে কাছে টেনেছেন। আমার এক ছাত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল, তাকে আমি ও আমার এক সহকর্মী দেখতে গিয়েছিলাম। ছোটখাটো গড়নের মেয়েটিকে অসুখের আক্রমণে আরও শীর্ণকায় মনে হচ্ছিল, বিছানার সঙ্গে মিশেছিল সে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার কি কিছু লাগবে, কোনো বই। সে বালিশের নিচ থেকে দুটো বই বের করে বলেছিল, স্যার, যদি হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নিয়ে দিতে পারেন। স্যার হয়তো হুমায়ূন আহমেদকে চিনবেন, কারণ তিনিও তো স্যার।
আমাকে বেশ কষ্ট করে অটোগ্রাফ আদায় করতে হয়েছিল, কিন্তু বই দুটি ফেরত দিতে গিয়ে মনে হলো, মেয়েটির রোগ যেন অর্ধেক নিরাময় হয়ে গেল।বড় ভাইয়ের জন্মদিন এবং...0%গড় রেটিং:রেটিং :আ হ সা ন হা বী বহুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন ছবি : মাসুদ আখন্দ
এ রকম কত গল্প, কতসব মজার কাণ্ড আমাদের ছোটবেলাজুড়ে সে করেছে, তার হিসাব নেই। আজ এত বছর পর যখন পেছনের দিকে তাকাই তখন মনে হয়, ছোটবেলায় এ রকম বড় ভাই পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। তার জন্মদিনে তার প্রিয় পাঠকদের সঙ্গে এই পত্রিকা মারফত 'অফিসিয়াল শুভেচ্ছা' জানাই তাকে, পারিবারিক শুভেচ্ছা তো পারিবারিকভাবেই হবে
সমকাল থেকে বলা হয়েছে, আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে স্মৃতিকথা-টাইপ কিছু লিখতে হবে। কিন্তু তার গত বছরের জন্মদিনে আমি অন্য একটি পত্রিকায় তাকে নিয়ে বেশ বড়সড় একটা লেখা লিখে ফেলেছি। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, তাকে নিয়ে প্রায় সব ঘটনাই লেখা শেষ। নতুন কী আর লিখি। স্মৃতি তো কতই আছে, সব কি আর সময়মতো মনে পড়ে?
আমরা ছয় ভাইবোন। তিন বোন ও তিন ভাই। তার মধ্যে তিন ভাইবোনের জন্মদিন নভেম্বর মাসে। নভেম্বরের ৯ তারিখ আমার বড় বোন সুফিয়া হায়দারের জন্মদিন (সে অতিসম্প্রতি একটি সরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে রিটায়ার্ড করেছে)। বড় বোন বলে কথা। তার ওপর নভেম্বর মাসের প্রথম জন্মদিন। মোটামুটি ভালোভাবেই পালন হয় বড় বোনের জন্মদিনটা। তারপর ১৩ নভেম্বর বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তার জন্মদিনের কথা আর নতুন করে কী বলব। তার ভক্তরা পালন করে, প্রকাশকরা পালন করে, মিডিয়ার লোকজন পালন করে... পারিবারিকভাবে আমরা তো আছিই। পরপর দুই জন্মদিন পালন করে আমাদের পরিবারের সব সদস্য একটু যেন ঝিমিয়ে পড়ে; কিন্তু তারপর যে জন্মদিনটি এসে হাজির হয় (মহান) ১৫ নভেম্বর, তার কথা কে মনে রাখে? বোনরা ফোন করে বলে_
_ ভাইয়া, তোর জন্মদিনে না এলে মাইন্ড করবি?
আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলি_ 'না'। ভাগি্ন-ভাস্তিরা ফোন করে বলে, 'শাহীন মামা... এবার আসতে পারলাম না, আগামীবার দেখো ফাটাফাটি জন্মদিন হবে তোমার। তবে চিন্তা করো না, গিফট কিন্তু কিনে রেখেছি।'
স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলে, 'খামাকা এতকিছু রান্না করলাম, এগুলোর কী হবে? কেউ তো এলো না। তোমার অফিসের কেউ এলেও তো পারত নাকি?' আমি দ্বিতীয়বার দীর্ঘশ্বাস গোপন করে দাউদ হায়দারের সেই বিখ্যাত কবিতার বই খুলে বসি_ 'জন্মই আমার আজন্ম পাপ'।
পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন, বড় ভাইয়ের জন্মদিন নিয়ে লিখতে বসে নিজেরটা ঢোল পেটাচ্ছি কেন? আমার কী দোষ? যুগটাই হয়েছে এমন... নিজের ঢোল নিজে পেটাও, অন্যকে দিলে ফাটায়া ফেলতে পারে। তবে এই ঢোলদর্শন আরেকটু আপগ্রেড হয়েছে... 'নিজের ঢোল নিজে পেটাও অন্যকে দিলে ঢোলই গায়েব করে দিতে পারে...'। তাই ভাবলাম, বড় ভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষ করে বরং নিজেরটাই একটু...
তবে এটা ঠিক, আগে কখনই আমাদের পরিবারে জন্মদিন হতো না। জন্মদিন কী জিনিস, বুঝতামই না। কখন কার জন্মদিন, কোন দিক দিয়ে চলে যেত টেরও পেতাম না। এখন বড় হয়ে একটু-আধটু জন্মদিন হচ্ছে, তা-ও আমাদের অফস্প্রিংরাই বোধহয় এর উদ্যোক্তা। তবে এদিক দিয়ে বোধহয় আমি খুবই ভাগ্যবান। সেটা হচ্ছে একবার কী কারণে ছোটবেলায় আমার বড় ভাইবোনরা ঠিক করল, একটা জন্মদিন করা হোক। জন্মদিন করলে কেমন লাগে, সেটা টের পাওয়া যাক। একটা এক্সপেরিমেন্ট আর কী। কিন্তু কার জন্মদিন করা যায়? কপাল ভালো বলতে হবে আমার, তখন আমার জন্মদিনটাই বোধহয় সামনে ছিল!
মনে আছে, সেই জন্মদিনে বড় ভাই একটা বই উপহার দিয়েছিল। সেটা হচ্ছে আমার জীবনে পাওয়া প্রথম বই উপহার। প্রথম জন্মদিনের উপহারও বটে। বইটার নাম ছিল 'বাবা যখন ছোট', রাশান বই। অসাধারণ একটা বই। সেই বই এখনও আছে। এখনও মাঝে মধ্যে সেই বিখ্যাত বইয়ের পাতা ওল্টাই। মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কত স্মৃতি, ভাইবোনদের নিয়ে কত আনন্দের ঘটনা। তখন টিভি ছিল না, কম্পিউটার ছিল না, মোবাইল ছিল না... কিছুই ছিল না। কিন্তু আনন্দের কোনো কমতি ছিল বলে মনে হয় না। আর সব আনন্দের মূলে ছিল বড় ভাই (আমরা ডাকি দাদাভাই) হুমায়ূন আহমেদ। অদ্ভুত অদ্ভুত সব আইডিয়া তার মাথায় আসত। একবার সে বাইরে থেকে এসে বলল, 'সিগারেট খাবি?' আমি তখন ওয়ানের ছাত্র আর সে সম্ভবত এইট-নাইনে উঠেছে। বললাম, খাব। কারণ আমি জানি, এর মধ্যে নিশ্চয়ই আনন্দের কোনো ব্যাপার আছে! সে বলল, চোখ বন্ধ কর। আমি বন্ধ করলাম।
সে সত্যি সত্যি মুখে একটা সিগারেট গুঁজে দিল। তবে এই সিগারেট সত্যি সিগারেট নয়। কাঠি লজেন্স! সিগারেটের মতো দেখতে লম্বা চকোলেট। সেও একটা মুখে গুঁজল। তারপর পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে মিছিমিছি আগুন ধরাল চকোলেটের মাথায়। তারপর দু'জনে দিব্যি টানতে লাগলাম (মানে চুষতে লাগলাম)।
এ রকম কত গল্প, কতসব মজার কাণ্ড আমাদের ছোটবেলাজুড়ে সে করেছে, তার হিসাব নেই। আজ এত বছর পর যখন পেছনের দিকে তাকাই তখন মনে হয়, ছোটবেলায় এ রকম বড় ভাই পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। তার জন্মদিনে তার প্রিয় পাঠকদের সঙ্গে এই পত্রিকা মারফত 'অফিসিয়াল শুভেচ্ছা' জানাই তাকে, পারিবারিক শুভেচ্ছা তো পারিবারিকভাবেই হবে।
আহসান হাবীব, উন্মাদ সম্পাদক, হুমায়ূন আহমেদের ছোটভাইএসএসসি পরীক্ষা0%গড় রেটিং:রেটিং :ম ম তা জ শ হী দদুই ছেলের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ
দাদাভাই পরীক্ষা দিতে গিয়ে ঘরে এসে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষার দিন তার মনে হলো, সে রোল নম্বরের আগে ইড়ম লেখেনি হয়তো। ব্যস। দুরন্ত টেনশন। এত পড়া সব জলে যাবে। কিন্তু ওর ভাগ্য ভালো। আমি বললাম, তুমি চলো আমার সঙ্গে চঞ স্কুলে স্যারের বাসায়। বেশি বুঝিস। স্যার এখন কী করবে? খাতা চলে গেছে রাজশাহী। গেলে তুই একা যা। আমি একাই গেলাম। গিয়ে সব বললাম। স্যার বললেন, তোমার ভাইকে নিয়ে আসো। স্যারের বাসায় ওকে রেখে চলে এলাম
হুমায়ূন আহমেদকে আমরা ভাইবোনেরা ডাকি দাদাভাই বলে। দাদাভাই যখন এসএসসি দেয়, তখন আমি পড়ি ক্লাস ফাইভে। পিটি স্কুলে তার সিট পড়েছিল। বগুড়ায় এ স্কুলটি আমাদের বাসার কাছেই। আমি আর শাহীন (আহসান হাবীব) হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যেতাম। সেটা আমাদের স্কুল।
দাদাভাই যখন পর্যন্ত ক্লাস সেভেনে পড়ে একেবারে ভেদা স্টুডেন্ট। ওদিকে ভাইয়া ইস্পাত। কোনোদিন সেকেন্ড হয় না, বৃত্তি পায়! (ভাইয়া হচ্ছে জাফর ইকবাল)
যাক। হঠাৎ যখন ও ক্লাস এইটে উঠল পুরো বদলে গেল। দারুণ রেজাল্ট! এমনকি বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার চান্সও পেল। ওমা, রেজাল্ট শুনে জানা গেল, সে পেয়েছে রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশিপ। এই হলো তার ভালো ছাত্র হয়ে যাওয়ার শুরু। আব্বাও খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। বিএ পাস করেছিলেন ফার্স্ট ডিভিশনে। পরের জেনারেশনের প্রথম মানুষটি ভালো ছাত্র না হলে খারাপ দেখায়। খুব খুশি সবাই।
যাক বলছিলাম এসএসসি নিয়ে। তার অঙ্কের জন্য (ইলেকটিভ অঙ্ক) টিচার দরকার কি-না বুঝতে না পেরে সে গেল তাদের স্কুলের অঙ্ক টিচারের কাছে। উনি নিজে বলে দিলেন_ দেখ, অঙ্কে তুমি লেটার পাবেই। আম্মাকে এসে বলে দিল সব। কী যে পড়া পড়ত সারাটা দিন। আমার মনে আছে। আম্মা তখন মাটির চুলায় রাঁধতেন। ঘরে লাকড়ি থাকত। মাঝে মধ্যে সে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত, আমাকে বা শাহীনকে ডাকত 'আয় খেলা হবে' বলে। তারপর পাঁচ-দশ মিনিট এক টুকরা ইটকে দু'জন ঠোকাঠুকি করেই আবার পড়তে বসে যেত।
এদিকে এক কাণ্ড ঘটে বসল। তার ক্লাসের এক ছেলে হোস্টেলে সিট পাচ্ছে না (বগুড়া জিলা স্কুল), খুব ঝামেলা যাচ্ছে। আম্মাকে দাদাভাই বলল, আম্মা ওকে বাসায় নিয়ে এলে কেমন হয়? একটা রুম তো খালি আছে বাসায়। আম্মা রাজি হয়ে গেলে সেই ছাত্র আমাদের বাসায় এসে উঠল। মহাবিপদ! মহাবিপদ! তার রুমের পাশেই আমাদের কুতকুত খেলার জায়গা। বহুদিন সেখানে খেলতে খেলতে খেলার দাগগুলোতে নিজে থেকে দাগ বসে গেছে। ওমা একজন একটু কুতকুত মাত্র বলেছি, সে গিয়ে আম্মাকে রিপোর্ট_ আম্মা, এরা আমাকে পড়তে দেয় না, সারাদিন খেলে, এই দেখেন ঘর আঁকা। ব্যস, আমার ছুটি ফুরিয়ে গেল। রাগে-কষ্টে চোখে পানি এসে যায়। কিন্তু কিছু করার নেই। তারও তো এসএসসি। তিনি এখন বড় ডাক্তার। নাম ডাক্তার করিম।
যাক, দাদাভাই পরীক্ষা দিতে গিয়ে ঘরে এসে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষার দিন তার মনে হলো, সে রোল নম্বরের আগে ইড়ম লেখেনি হয়তো। ব্যস। দুরন্ত টেনশন। এত পড়া সব জলে যাবে। কিন্তু ওর ভাগ্য ভালো। আমি বললাম, তুমি চলো আমার সঙ্গে চঞ স্কুলে স্যারের বাসায়। বেশি বুঝিস। স্যার এখন কী করবে? খাতা চলে গেছে রাজশাহী। গেলে তুই একা যা। আমি একাই গেলাম। গিয়ে সব বললাম। স্যার বললেন, তোমার ভাইকে নিয়ে আসো। স্যারের বাসায় ওকে রেখে চলে এলাম।
ঘণ্টাখানেক পর হাসতে হাসতে বাসায় এলো। স্যার তাকে ফজলি আম খেতে দিয়ে বলেছেন, সব ঠিক আছে।
দাদাভাই তো টেনশনে বাকি পরীক্ষাগুলো ৩২ বা ৩৩ পেত, যদি আমি স্যারের বাসায় নিয়ে না যেতাম। অর্থাৎ থার্ড ডিভিশন!!
এদিকে ছুটির মধ্যে আব্বা আম্মাকে নানাবাড়ি বেড়াতে পাঠালেন। খুবই মজা। সেখানে শুনি, আমার এক খালার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। হঠাৎ শোনা গেল, রাজশাহী বোর্ডের এসএসসির রেজাল্ট বের হয়ে গেছে। প্রথম হয়েছেন...
কতক্ষণ পরই আবার খবর। এবার বলছে দ্বিতীয় হয়েছেন 'হুমায়ূন আহমেদ', রোল নম্বর-২৫৮৮৮! ওমা, এ যে আমাদের দাদাভাই। আব্বা রোল নম্বরের কি সব গোনাবাছা করে প্রথমই আম্মাকে বলেছিলেন, দেখো ও খুব ভালো রেজাল্ট করবে। ওর জন্ম তারিখ ১৩। ১+৩=৪। ওদিকে ২+৫+৮+৮+৮=৩১ অর্থাৎ ১+৩=৪। বেচারা আব্বা আনন্দগুলো দেখলেন না। নানা-মামারা প্রচুর মিষ্টি এনেছিলেন। পটকা এনেছিলেন। তারাবাতি এনেছিলেন। এ তো অন্য রকম বিয়েবাড়ি।
আর আব্বা ছুটি পাননি বলে বগুড়ায় একা একা। ভালো লাগে না। আনন্দের সময় অনেক মানুষজনের কাছে থাকতে ভালো লাগে। বেচারা।
* তখন যেখান থেকে পরীক্ষা দিতে হতো তার সামনে উল্লেখ করতে হতো Bog (Bog=Bogra), Com (Com=Comilla) এসব। এখনও ওসব আছে কি-না জানি না।
মমতাজ শহীদ
হূূমায়ূন আহমেদের ছোটবোনবড় মামা0%গড় রেটিং:রেটিং :অ প লা হা য় দা র
আমার নাম অপলা দেখে সবার ধারণা বড় মামার (হুমায়ূন আহমেদ) উপন্যাস থেকে আমার নামটি রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। বড় মামার আমার নামটি পছন্দ দেখে তার কয়েকটি গল্প-উপন্যাসে এ নামটি ব্যবহার করেছেন। ভিকারুননিসা কলেজে ভর্তির জন্য যখন লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম তখন আমার পেছনের মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, 'তোমার নাম কী'? নাম শুনে বলল_ 'সুন্দর নাম তো। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নিশ্চয়ই তোমার মার প্রিয়, তাই ওনার বই থেকে নামটি নিয়েছেন।' উত্তরে সেদিন আমি হেসে বললাম, 'নাহ্, হুমায়ূন আহমেদের আমার মার রাখা নামটা প্রিয় তাই তিনি ব্যবহার করেন।' মেয়েটি উত্তরে হেসে বললেন_ 'ভালোই বলেছে।' মেয়েটি যেটাকে ঠাট্টা ভেবেছে ওটাই যে সত্যি তা আর কেন জানি বলতে ইচ্ছা হলো না।
বড় মামার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আমার জীবনের দুটি ঘটনা বলি :
ঘটনা-১ বড় মামার ঈদের সালামি দেওয়ার নিয়মটি ছিল একটু ভিন্ন। যেমন_ যার বয়স ৫ বছর সে পাবে তার ডাবল ১০ টাকা, আবার যার বয়স ১০ বছর সে পাবে ২০ টাকা। ফলে বড়রা সালামি পাওয়ার ক্ষেত্রে লাভবান হতো বেশি। একবার বড় মামাকে ঈদে সালাম করতে গেছি, গিয়ে দেখি তিনি পা তুলে চেয়ারে বসে আছেন। আমি ভয়ে ভয়ে (এখানে উল্লেখ্য বড় মামাকে আমরা সবাই কোনো এক বিচিত্র কারণে খুব ভয় পাই) বললাম, বড় মামা তোমাকে সালাম করতে এসেছি। বড় মামা গম্ভীর হয়ে বললেন, পা নামাতে পারব না। হাঁটু সালাম করে চলে যাও। আমি মনে মনে হাঁটু সালাম করলাম। পরে বড় মামা ১০ টাকা সালামি দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, বড় মামা আমার বয়স এখন ১০, আমি ২০ টাকা পাব। উনি বললেন, না, হাঁটু সালাম করেছ তাই পাবা হাফ। আমার সেদিন এত কষ্ট লাগল!
ঘটনা-২ আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষা দেব। বড় মামা খামে করে পরীক্ষার সালামি পাঠালেন। ওপরে লেখা বৃত্তি না পেলে ফেরত দিতে হবে। যথারীতি আমি বৃত্তি পাইনি। মাকে আমি সরলমনে জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা কি সত্যি ফেরত দিতে হবে। এ কথা বড় মামার কানে চলে গেল। বড় মামা ফোন দিয়ে বললেন, অমি, আমার টাকাটা খুবই দরকার তুমি এখনই পাঠাও। বড় মামা যে মজা করছেন তা আমি বুঝিনি, তাই অনুনয়ের সুরে বললাম, বড় মামা ঈদের আগে তো তোমাকে দিতে পারব না। ঈদের পর তোমাকে দিয়ে দেব। বড় মামা না না এখনই লাগবে_ বললেন। এই হচ্ছে আমাদের বড় মামা হুমায়ূন আহমেদ।
অপলা হায়দার, হূূমায়ূন আহমেদের ভাগি্নলেখক যাবে নদীর সন্ধানে0%গড় রেটিং:রেটিং :মু স্তা ফা জা মা ন আ ব্বা সী
কবির পথ ধরে বহুবার ঘুরেছেন তার বর্ণিত জগতে, গিয়েছেন পদ্মা, যমুনা, ইছামতি, বড়াল, করতোয়া, আত্রাই, চলনবিল, শাহজাদপুর, শিলাইদহ, পতিসর ও শত জনপদের গহনে। স্থিরচিত্র প্রথমে স্কেচ করেছেন, তারপর ক্যামেরায় বন্দি করেছেন 'ছিন্নপত্রে'র মহার্ঘ চরণগুলো। পদ্মাবক্ষে পালতোলা বজরা, দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে বিস্তীর্ণ পানির আহ্বান। দূরে দেখা যায় নিস্তব্ধ কোলাহলের মধ্যে প্রভাত সন্ধ্যা। দুরন্ত বালক তার ছাগ শিশুটিকে 'সিলহুয়েটে'র মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নদীর পাড় ঘেঁষে। আসল ধন কী, স্বর্গ কী বুঝতে হলে যেতে হয় নদী তীরে, ফুটে আছে যেখানে জীবন্ত শর্ষে ফুলের মধ্যে বিকশিত হলুদ আর পসরা নিয়ে চলেছে সলাজ গ্রামীণ মুখশ্রী সরু আলপথ ধরে
লেখককে যেতে হবে নদীতীরে। সেখানে যেন নিজেকে চিনতে পারি। অবিস্মরণীয় মুহূর্ত কেটেছে নদীতীরে। সুন্দর সে নদীর নাম, সুন্দর সে নদীর তীর। পদ্মা, মেঘনা, সুরমা, যমুনা, ডাকাতিয়া, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, আড়িয়াল খাঁ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, খোয়াই, চিত্রা, সুগন্ধা, কর্ণফুলী, মনু, কুশিয়ারা, তিস্তা, তোর্ষা, ইছামতি, গোমতি, কপোতাক্ষ, তিতাস, কালজানিসহ কয়েকটির নাম করলাম। প্রতি নদী নিয়ে বয়ে চলতে পারে আরেক লেখার বহতা। আমার লেখা নতুন উপন্যাস 'নদী উপনদী'তে আছে যাদের কথা। বিধাতাও বুঝি নদীতীরের স্বপ্ন দেখান মানুষকে সারা গ্রন্থজুড়ে। বিটিভির 'ভরা নদীর বাঁকে'তে নদীতীর ঘুরে এসেছেন নতুনরা। অধমের সঙ্গে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, মুর্শিদি, বাউলের আবর্তে। লোকসংস্কৃতির পরিচয়বাহী অনুষ্ঠান টোলের শিক্ষকের মতো দীর্ঘদিন চালিয়ে গেছি। নদী তীর সম্ভার অন্তরঙ্গই নয়, হয় অস্তিত্বের অঙ্গীভূত। শৈশব-কৈশোর-যৌবন-ভাটি জীবনের মহার্ঘ সওদা প্রস্তুত করে জলরাশি-কাদামাটি-মাঠঘাট-আকাশের মেঘ। কাশবনে সঙ্গে ছিলেন বিটিভির মুসা আহমেদ, আলী ইমাম ও আরও অনেক প্রডিউসার। শত কলাকুশলী নিয়ে উপস্থিত ছিলেন পল্লীবাংলার কয়েকশ' শিল্পী। এখন স্মৃতির শ্যাওলায় সবুজ।
নতুন প্রজন্মের জন্য এ লেখা, বড়দের জন্য নয়। তারা অনেক কিছু দেখে ফেলেছেন। কিছু সুজনের মতো হলো, যে উপন্যাসগুলো পঠিত সেগুলো বহুলালোচিতও বটে। সেগুলো তাকে তুলে রাখা হোক। ভ্রান্তি এখানেই। প্রতি সফল উপন্যাস বারবার পাঠ করার অবকাশ রাখে, প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনার। আমেরিকায় স্কুলে গিয়ে আমার চোখ খুলে যায়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য শিক্ষকদের কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, তা আমি দেখে এসেছি। তাই বলছি, এগুলো নতুন করে অধ্যয়ন করা হোক নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। দেশের নতুন শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে লুকিয়ে আছেন অমিত সম্ভাবনার রবিঠাকুর, নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কেমন করে হবে তাদের দৃষ্টিপাত 'শ্যামলে সবুজে নীলিমায় নীল' প্রকৃতির পানে। যারা নদীকে হৃদয় দিয়ে অবলোকন করেছেন তাদের করতে হবে আপন। কয়েকটি গ্রন্থের দিকে দৃষ্টিপাতের জন্য আমার এ আহ্বান। বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। আজ মাত্র ছ'টি।
তিতাস একটি নদীর নাম [১৯৫৬] : অদ্বৈত মল্লবর্মণ [১৯১৪-১৯৫১]
বাংলাভাষার বলিষ্ঠ কালজয়ী কথাসাহিত্যিকের লেখা, মহান শিল্পী উৎপল দত্ত ও ঋতি্বক কুমার ঘটকের পরিচালনায় যার অসামান্য উপন্যাস অবলম্বনে নাটক মিনার্ভায় অভিনীত হয় শতরজনী। ফিরে আসি 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে ও 'অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্রে', সংগৃহীত ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ আলোচনা চিঠিপত্রে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস তীরে মালোপাড়ায় সারাদিন। ভরা নদীর বাঁকে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মালোদের পাড়ায় খুঁজে পাই তার বসতবাটি, চারপাশে জেলেদের শুকাতে দেওয়া মাছের জালগুলো আর তার ভাইয়ের ফেলে যাওয়া অসংখ্য প্রাচীন লোকসঙ্গীতের উপাদান। ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটিতে লাখো বইয়ের মধ্যে খুঁজে পাই তার অমরগ্রন্থ ও তৎসঙ্গে ইংরেজি অনুবাদ। চিনলাম অদ্বৈতকে, লোকসঙ্গীতের অন্তরঙ্গ সাথী।
হিরামন মঞ্জিলে পিতা আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সম্ভবত 'মোহাম্মদী'তে কাজ করতেন। গ্রন্থটি বাঙালি মনোরাজ্যের প্রামাণ্য দলিল। যিনি স্পর্শ করবেন, জানবেন তিতাসের ঢেউ কি প্রবল, মৎস্য শিকারি মালোদের জালে লুকিয়ে আছে কত স্বর্ণালি উপাখ্যান, কত স্বপ্ন, কত সঙ্গীত। অদ্বৈত তিনি, যিনি বাংলার অমর লোকসঙ্গীতকে টেনে এনেছেন তার উপন্যাসে। অন্যরাও নমস্য, তবু বলতে হয়, অন্যদের লেখনীতে তা দূরাগত বংশীধ্বনি। নতুন লিখবেন যারা, যেন এ দিকটি খেয়াল রাখেন।
'পদ্মা নদীর মাঝি' [১৯৩৬] : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় [১৯০৮-১৯৫৬]
উপন্যাসটি পড়ার জন্য লেখকদের প্রতি আহ্বান। ডাক নাম মানিক, পোশাকি নাম : প্রবোধ কুমার। সান্নালের সঙ্গে দূরবর্তী হওয়ার মানসে ডাক নামের ব্যবহার। পাই নদীর মোহনা, ছোট দ্বীপগুলো, প্রেম-অপ্রেমের সংগ্রামে জীবনের জটিলতা। ঝড়-ঝঞ্ঝা-বাও-বাতাস, প্রকৃতির রূপবদল, সবুজ-শ্যামলিমা নির্মিত ছায়াছবির মধ্যে যেমন প্রতি দৃশ্যে, উপন্যাসে তেমনটি নয়। কপিলা, কুবের, হোসেন, মেজ বাবু, গোপী, বিপীন, গণেশ, আমিনুদ্দিন চরিত্র সজীব, নৌকার মধ্যে 'সাতজন মুসলমান মাঝি'র অবস্থান নতুন পাঠককে চমকে দেবে। ওরা কি তবে অন্য গ্রহের লোক?
'নদীর বিদ্রোহ' গল্পে খুঁজে পাই নদীকে
'নদীর ধারে তার জন্ম হইয়াছে, নদীর ধারে সে মানুষ হইয়াছে, চিরদিন সে নদীকে ভালোবাসিয়াছে। দেশের নদীটি তার হয়তো এই নদীর মতো এতবড় ছিল না, কিন্তু শৈশব, কৈশোর আর প্রথম যৌবনে বড়-ছোটর হিসাব কে রাখে?'
নদীগুলো বারবার ফিরে এসেছে। বিক্রমপুরের মালপদিয়া তার স্বগ্রাম।
'তিস্তা পারের বৃত্তান্ত' [১৯৮৮] : দেবেশ রায় [১৯৬১-]
'দেবেশ রায়ের তিস্তা পারের বৃত্তান্ত পেঁৗছেছে কি'? প্রখ্যাত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর ছেলে উৎপলেন্দুও ভালো গায়। কলকাতার নতুন 'মল'-এ বইয়ের দোকানে পেলাম ৫০৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থ। পরিচিত হই গয়ানাথের জোতজমি, বাঘারুর নির্বাসন, নিতাইদের বাস্তুত্যাগ ও সীমান্ত বাহিনীর সীমান্ত ত্যাগ, উত্তরখণ্ডের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র দাবির সঙ্গে।
কালিম্পং থেকে নেমে এসেছে তিস্তা, গজালডোবা, আপলচাঁদ ফরেস্ট, ক্রান্তিহাট, চ্যাংমারিহাট, জলপাইগুড়িসহ ধরমপুর পার হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের সীমান্তে। ভুটান থেকে নেমে নাগরাকাটা, ধূপগুড়ি হয়ে জলঢাকা নদী। পূর্ব ভুটান থেকে নেমে এসেছে তোর্ষা, মাদারিহাট হয়ে স্বগ্রাম বলরামপুরে এসে নাম, কালজানি, শৈশব-কৈশোরের রোমান্স দিয়ে প্রস্তুত অনন্য জলস্রোত, জীবন নদীর উজানেতে যার কথা। রাজনীতি সম্পৃক্ত উপন্যাস, বন্যায় উদ্বাস্তু নমঃশূদ্র চাষি, চরভাঙ্গায় বিধ্বস্ত লুঙ্গি পরা আজিজ, মেখলিগঞ্জ, হলদেবাড়ির ছিটমহলে উঠে এসেছে উপাখ্যান, পাঠককে করে সমৃদ্ধ।
দেবেশ রায় সম্ভবত পূর্ববঙ্গ থেকে আগত, উত্তরাঞ্চলের মনন রাতারাতি তার হবে না, এটিই স্বাভাবিক। ওই মাটিতে বড় যারা, পার্থক্যটি অনুধাবন করতে পারি। পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা ভাওয়াইয়া গায়ক ড. সুখবিলাস বর্মা, বললেন, সবই আছে, নেই উত্তরবাংলা। নদী-মানুষ-রাজনীতি সাধারণ মানুষকে কীভাবে জাগায়, কীভাবে তলায় তার কথা সুন্দরভাবে লেখা। নেই উত্তরের সংস্কৃতি : ভাওয়াইয়া-চটকা-ক্ষিরোল-পালাগান-বৈরাতি-রাজবংশী-মেচরাভা-চা বাগান।
উত্তরবঙ্গেই আছে এমন বন, যার তলে দিনের আলো পেঁৗছে না, এ মাটিতেই কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুদয় পূর্ববাংলা থেকে ভিটে হারানো হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে, করতোয়া নদী দেবীর করধোয়া, 'জলপাইগুড়ি, শীতবুড়ি শুয়ে থাকে দিয়ে লেপমুড়ি'। এতদ্সত্ত্বেও, তিস্তার উলেল্গখযোগ্য দলিল এটি। উত্তরবাংলা নিয়ে লিখলে অনুরোধ করব লোকসংস্কৃতির গভীর অধ্যয়ন।
'কাশবনের কন্যা' [১৯৫৪] : শামসুদ্দিন আবুল কালাম [১৯২৬-১৯৯৭]
শামসুদ্দিন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা আমার পড়া প্রথম উপন্যাস। বায়ান্ন থেকে চুয়ান্ন_ তিনি প্রায়ই আসতেন পুরানা পল্টনে আমাদের বাড়িতে। তার দীর্ঘ সুশ্রী অবয়ব, মিষ্টি করে কথা বলা আকৃষ্ট করত। কামরুল হাসানের স্কেচ ও লোকবৃত্তের শ্রেষ্ঠ গানের উদ্ধৃতি সুশোভিত কাশবনের কন্যাকে কি সুমধুর ব্যঞ্জনায় করেছিল মুখরিত।
শামসুদ্দিন আবুল কালামকে ভালো লাগার কারণ, এই কাশবনেই তার চয়ন করা রাজকন্যা প্রেম সুধায় মাটির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন পাঠকদের। শামসুদ্দিন দেশ ছেড়েছিলেন, কাশবনের আড়ালে রমণীর সুমধুর প্রেমের স্মৃতিকে নয়। রমণীর প্রেমই নদী তীরের সম্পদ।
দীর্ঘদিন পর তাকে চিঠি লিখি, যখন তিনি রোমে। লিখলাম, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস এটি, এর চলচ্চিত্রায়নে আমি আগ্রহী। কয়েকটি চিঠি লেখেন, উঁইপোকায় তা ভক্ষণ করেছে। লিখেছেন : নদী তীর চোখের প্রথম দৃষ্টি, ওইটি যেন হয় শেষ। ছবি করা হয়নি।
'পদ্মার পলিদ্বীপ' :আবু ইসহাক
'সূর্যদীঘল বাড়ি'র আবু ইসহাক। পদ্মার পলিদ্বীপ-এ বর্ণিত অনেক গ্রাম। যে গ্রামগুলো আমাদের এত আপন। আশ্রয় করে নিয়েছে আবু ইসহাকের স্বগ্রাম শিরঙ্গম, শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার অন্তর্গত ঘুমিয়ে থাকা গ্রাম, আজও।
আমারও আছে গল্প। পাশের গ্রামেই কাটিয়েছি পনের দিন, ভয়ঙ্কর ঝড়ে যেখানে উড়ে গিয়েছিল গ্রামের সব ঘরবাড়ি, প্রাণ হারিয়েছিল শত শত মানুষ। সালটি ছিয়াশি। দেড়শ' ঘর বানিয়ে দিয়েছিলাম দাঁড়িয়ে থেকে সহযাত্রী নুরুদ্দিন তওফিক-উল-ইসলামের সঙ্গে। চরমপন্থির একজন হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে আমাকে পেটের মধ্যে রিভলবার ঢুকিয়ে প্রশ্ন করলেন : এখানে কী কাজ? উত্তর দিলাম : অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছি, ঘর বানিয়ে দিচ্ছি, দেখতে পাও না? চোখে আমার অশ্রুবিন্দু, ভয়ে নীল। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ শত অকৃত্রিম চিত্র, দ্বন্দ্ব-কলহ, সমাজের নানা স্তরে অজগর পদ্মার কীর্তি বিনাশী কর্মপ্রবাহ যদি তোমার জীবনের স্টোরির সঙ্গে জড়িয়ে নিতে চাও, বইটি পড়লেই পথ খুঁজে পাবে। যাকে চেনই না, তাকে নিয়ে কী লিখবে? যে গান শোননি, সে গান তোমার নয়। পঠিতব্য অশোক বিশ্বাসের 'নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পদ্মার পলিদ্বীপ' [কালি ও কলম : সপ্তম বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, ১৪১৭]।
'ছিন্নপত্র' [আলোকচিত্র] [২০০২] : ড. নওয়াজেশ আহমেদ [১৯৩৭-২০০৯] [রবীন্দ্রনাথের 'ছিন্নপত্র' অবলম্বনে আলোকচিত্র সম্ভার]
'ছিন্নপত্র' আলোকচিত্র। উপন্যাস নয়, গল্পও নয়। ড. নওয়াজেশ আহমেদ সমবয়সী। বললাম, এ কি অসাধারণ কাজ আপনার, বইমেলার পর কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের এক অভ্যর্থনা সভায়। জানালাম, রবীন্দ্রনাথকে কত গভীরভাবে স্পর্শ করে তার চোখ দিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন নদী তীরে দীর্ঘদিন, সঙ্গে দোসর ক্যামেরা।
জিজ্ঞেস করলেন, কোন ছবিগুলো আপনার মনে দাগ কেটেছে।
বললাম : প্রতিটি। কবির পথ ধরে বহুবার ঘুরেছেন তার বর্ণিত জগতে, গিয়েছেন পদ্মা, যমুনা, ইছামতি, বড়াল, করতোয়া, আত্রাই, চলনবিল, শাহজাদপুর, শিলাইদহ, পতিসর ও শত জনপদের গহনে। স্থিরচিত্র প্রথমে স্কেচ করেছেন, তারপর ক্যামেরায় বন্দি করেছেন 'ছিন্নপত্রে'র মহার্ঘ চরণগুলো। পদ্মাবক্ষে পালতোলা বজরা, দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে বিস্তীর্ণ পানির আহ্বান। দূরে দেখা যায় নিস্তব্ধ কোলাহলের মধ্যে প্রভাত সন্ধ্যা। দুরন্ত বালক তার ছাগ শিশুটিকে 'সিলহুয়েটে'র মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নদীর পাড় ঘেঁষে। আসল ধন কী, স্বর্গ কী বুঝতে হলে যেতে হয় নদী তীরে, ফুটে আছে যেখানে জীবন্ত শর্ষে ফুলের মধ্যে বিকশিত হলুদ আর পসরা নিয়ে চলেছে সলাজ গ্রামীণ মুখশ্রী সরু আলপথ ধরে। আপনি উপলব্ধি করেছেন শস্যক্ষেত্রের কাটাকাটা বিন্যাস, যেখানে গরুর মুখে জোয়াল দিয়ে হাল বইছেন হাড়জীর্ণ কৃষক, একই ছবিতে বপন করছেন শস্য তার স্ত্রী ও পুত্র। চিত্রটি মনে গাঁথা হলেই বোঝা সম্ভব হবে কৃষকের কষ্ট ও অনুভূতি। কত কষ্টে কত ধান, কত ধানে কত চাল, কত চালে কত ভাত।
কথা বলছিলাম, আর নওয়াজেশ প্রায় কেঁদে ফেলেন।
১৫২ পৃষ্ঠার বইটি খুলে পড়ি। পড়ি, রবিবাবুর 'ছিন্নপত্র'...। 'আবার সেই বালিকাটিকে সেই গরাদের জানলার সম্মুখে দেখা যাইতেছে এবং ঘরের মধ্যে সেই যুবাপুরুষটি বসিয়া আছে। আকাশে মেঘ-রোদ্রের খেলা যেমন সামান্য, ধরাপ্রান্তে এই দুটি প্রাণীর খেলাও তেমনি সামান্য, তেমনি ক্ষণস্থায়ী।'
ছবি আঁকতে পারে অনেকটাই। গান মূর্ত করতে পারে আরও খানিকটা। ধারণ করার ক্ষমতা শুধু লেখনীর।
নিজ দর্শন ঃ
জানিয়েছি, লিটল ম্যাগাজিন রোটার্যাক্টে যমুনাবক্ষে নিবন্ধে :
প্রমত্ত যমুনায় ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় অধম। ভাটিয়ালির টানে বিভোর আকাশের দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি। মুহূর্তে শীতল বাতাস। কালো মেঘপুঞ্জ ছুটে আসে দৈত্যের মতো ডিঙ্গি নৌকাটিকে গ্রাস করতে। তলিয়ে যাচ্ছি চিরতরে, বিপন্ন অস্তিত্ব বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদ।
মাঝি সাঁতার জানে, আমিও। দু'কূল ছাপানো নদীতে টিকে থাকব মিনিটখানেক। চকিতে পুলসিরাত দেখতে পাই। সরু পুলটি, হেঁটে চলেছে লাখ লাখ দিগ্গি্বদিক শূন্য মানুষ। প্রতিকূলতায় ছিটকে পড়ছে মানুষ নদীর দু'ধারে।
মেঘবজ্র হুঙ্কার ও বাতাসের শন শনের মধ্যে জীবন-মৃত্যু।প্রথম প্রেমের মতো গূঢ় কষ্ট0%গড় রেটিং:রেটিং :ফা রু ক মা হ মু দ
বৃদ্ধের চিন্তার ফাঁদ... প্রকৃত দুঃখের পাশে দুঃখখণ্ড রোদনের ভাষা
বিক্ষত হয়েছি বটে। অনেক রৌদ্রের দিন, পাপপুণ্য জলের পিপাসা
পেছনে তাকাতে নেই। বাতাসের বোবা ঠোঁটে সময়ের দীর্ঘ অপচয়
তখনো বলার থাকে_'প্রথম প্রেমের মতো গূঢ় কষ্ট একবারই হয়।'
ভেঙে গেছে দুঃখচূড়া। হাসি ওড়ে। হাসি ফোটে বিচ্ছেদের দূর অবশেষে
যখনি প্রেমের গল্প_তীর্যক আলোক-রেখা সুরঙ্গের মৌনপ্রান্তে মেশে
শিল্পের সকল সত্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী; নিদ্রাজড় মানুষের সহজতা আঁকে
আস্থার নকলচিহ্ন। সময় বুড়িয়ে যায়_শব্দ-বর্ণ তবু বেঁচে থাকে
যেখানে রূপের ছটা_যথেষ্ট আঁধার থাকে, সাফল্যের থাকে আর্তনাদ
ছায়ার সন্ধান কোরো, জলের দাগের মতো মুছে যাবে বিরহ-বিষাদ
দুঃখ কি বহনযোগ্য? আগুনের যাত্রীধারা পরিপত্র সাফল্যের কাছে
সকল নারীর কণ্ঠে একটাই কান্নাগীতি, জ্বলাশব্দ থিতু হয়ে আছে
দুরূহ মুক্তির চেয়ে অগি্নকে ঝাঁকিয়ে সুখ। যে কখনো অশ্রুবন্ধ্য নয়
তার কাছে বলতে চাই_'প্রথম প্রেমের মতো গূঢ় কষ্ট একবারই হয়।'আমরা কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম (পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রদ্ধাস্পদেষু)0%গড় রেটিং:রেটিং :জা হি দ হা য় দা র
একটি পাপড়ি আমাদের অবহেলা ক'রে
মন্দ্রাকান্তা ছন্দে ঝরে গেল,
বিষণ্নম্ন কবিতা পাঠ করে হালকা বাতাস।
কবিরা প্রস্তুত। সকলেই বেছে নিয়েছে শ্রেষ্ঠ কবিতা।
দুলছে গোলাপ, কবিতার আনন্দ প্রতিমা;
তার এতো কেন রূপায়ণযোগ্যতা?
মঞ্চের কাছে একটি শিশু। ছেঁড়া জামা পরা।
ধুলোমাখা মুখ। চোখের তারা জ্বলছে।
লোকগুলি সেজেগুজে ওইখানে বসে আছে কেন?
কাজ নেই তাদের?
নাকের শিকনি ঝেরে শিশু চলে গেল।
দর্শকদের সারিতে দুই জন তরুণ-তরুণী।
হাত ধ'রে আছে। মনে হয়, কিছু শান্তি ধ'রে আছে।
কথা বলছে না। না বলুক। কথা বলছে হৃদয়।
অদূরে আলেকজান্দ্রিয়া ক্যাসেল।
ওই সিঁড়ি ভেঙে রবীন্দ্রনাথ দুর্গে গেছেন।
খোরশেদ আর আমি উঠেছি নেমেছি।
কবিসঙ্গ স্মৃতির ঈশ্বর।
সব কবির নিজের দুর্গ আছে।
ঘোষণা শুনলাম।
প্রধান অতিথি পথে।
কবিরা নদীতীরে বসে চা পান করুন।
ব্রহ্মনাদহীন ব্রহ্মপুত্র। সহনীয় পারাপার হাসে।
ক'জন যৌনকর্মী সাঁতার কাটছে।
জীবনের রাত্রি ধোয়া সাঁতার।
গরুর দুধের চা। খাঁটি দুধ।
চিনি দেবেন না আমাকে, আসাদকে দিন।
'এই তরমুজ পেলে কোথায়? এক ফালি দাও',
কবি কামড়ায় বাঁকা লাল চাঁদ।
আমরা ফিরিনি মঞ্চে।
খুলি নাই কবিতার খাতা।
আমাদের সুধী ব্যবহার দেখে
ব্রিজের গ্রীবার 'পর হাসলো ধ্রুবতারা।
চাকা ডাকলো, চলো, বড় হচ্ছে রাত।
ফিরে যাচ্ছি ঢাকার জঙ্গলে।
'শাহরিয়ার, কতদূর?'
'আমরা ছেড়েছি শালবন',
'আমরা ঢুকছি শালবনে',
'আজকে পূর্ণিমা, বাম দিকে তাকান, বনের মাথায় টিপ';
অনেক বছর পর,
পড়া হলো, দেখা হলো, শোনা হলো মৌলিক কবিতা।বাঁচাও আমার কুশপুতুলকে0%গড় রেটিং:রেটিং :জু য়ে ল মা জ হা র
শখ হয়েছিল, তাই বানালাম নিজের কুশপুতুল
বাজারে গেলাম কিনে আনলাম সবই
কুশ, রঙ, সুই, সুতো আর এটা-ওটা
তারপর বসে একমনে একাএকা
শুরু করলাম নিজের পুতুল গড়া
ব্যর্থ অনেক প্রহরের গুরুভার
সহ্য করেছি; তারপর সফলতা
নিজেকে শুনিয়ে বলে উঠি 'ইউরেকা'
সেই পুতুলকে বুকে নিয়ে প্রতিরাতে
যাই ঘুমাতে ক্লান্ত শিশুর মতো
তারপর এলো অচিন্ত্য বিভীষিকা
দৈত্যের দল সমূহ হুহুঙ্কারে
স্বপ্নে দেখি কী, অচেনা অনেক লোক
চেঁচিয়ে বলছে, শালারে পেয়েছি বাগে
আকাশে বাতাসে হাঁউ মাঁউ আর খাঁও:
'ছিড়ে নে মুণ্ড, ছিড়ে নে ধড় ও ঊরু
অ দুটিরে পুরে নে মুঠোয় আর
শিল ও নোড়ায় বেটে কর কিমাকার!'
তারপর আর মনে নেই কিছু, শুধু
স্বপ্ন থেকে পালিয়ে আর্তনাদে
ছুটছি এবং চাইছি একটি ঘোড়া;
আমাকে এবং আমার কুশপুতুলে
সুরক্ষা দাও স্বপ্নের ক্ষোভ থেকে
বিনিময়ে দেব মুখর রাজ্যপাট!শূন্য0%গড় রেটিং:রেটিং :মা মু ন খা ন
আমার সবচেয়ে সুন্দর দিনটিতে আমি থাকবো না।
আমাকে ঘিরে চারপাশে ফুটে থাকবে
অজস্র নরম দৃশ্য_
গন্ধ উড়বে, পাথর গলবে
শংসাতরঙ্গে 'হ্যাঁ' 'হ্যাঁ' করে কাঁপবে বাতাস
মৃদু-পাপড়ি আর মৃত্তিকার বিক্ষত পরতে পরতে
বাজতে থাকবে অন্ধ-এস্রাজ...
শতদিক থেকে স্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে ছুটে আসা শত শত স্বজন
ভেজা আকাশের ছায়া মেখে মুখে
দেখতে থাকবে আমাকে_ আমার না-থাকাকে।
আমি দেখবো না এর কিছুই।
আমার কাছে এসবের কোনো মানেও আর থাকবে না।
আমি তো তখন এই মহাপ্রেক্ষাগৃহের সমস্ত
রঙ রেখা ঘ্রাণ প্রাণ ধ্বনি_ সবকিছুকে একাকার করে দিয়ে
অতিকায় কালো একটা 'শূন্য' হয়ে যাবো।গোত্রচূ্যতির ফল0%গড় রেটিং:রেটিং :টো ক ন ঠা কু র
যা লিখি তা কালো, ছাপা হয়ে যায়
শাদা পৃষ্ঠায়
যা লিখি না তা শাদা, শ্বাসপ্রশ্বাস
রাখি হাওয়ায়
খ.
লিখতে লিখতে, লিখি... আমি যাই লিখি
শ্রমজীবী মানুষের দিন, ভ্রমজীবী চন্দ্রনটিনীর ঝিকিমিকি
কিংবা অথবা অলসতা কত প্রকার ও কি কি_
লিখি আর ছাপা হয়ে যায় কাগজে কাগজে
লিখি আর তুমি পড়ো অপ্রেমের আপন গরজে
লিখি, কী লিখি তা সবসময় খুব অর্থবহ হয়ে ওঠে
কিংবা ফুল থেকে মৌচাক পর্যন্ত মাছিদের ভ্রমণকাহিনী হয়
_ সেই অর্ঘ্য দাবি করার মতো মহৎ মানুষের জীবনী
আমার পছন্দ নয়
লিখতে হয় লিখি, লিখলে শাদা পৃষ্ঠা মনোযোগে নষ্ট করা যায়
লিখতে লিখতে আমি নষ্ট করে ফেলতে পারি মন
লিখলে মনের রাক্ষসটা কালো অক্ষরের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে
আমি ওকে, রাক্ষসটাকে খুব ভালোবাসি, পছন্দ করি
প্রশ্রয় দিয়ে রাখি
ওই রাক্ষসটাই আমার প্রিয় বন্ধু, অন্তরঙ্গসঙ্গমাখা
'আমরা খুবই ফ্রেইন্ডলি'
ওকে, ওরফে রাক্ষসটাকে আমার ফাটাফাটি ভালো লাগে
গ.
ও একটা গোত্রচূ্যত, রাক্ষসের সমাজে ওর জায়গা হয়নি
কারণ, রাক্ষসপুত্র হয়েও সে ভালোবেসে ফেলেছিলো এক মানবীকে
এদিকে সেই অতিমানবীও শেষ পর্যন্ত গোত্রচূ্যত রাক্ষসের ঘর করতে
সাহস পায়নি,
অজ্ঞাত ভয়ে
এসব সেই পুরোনো গল্প, লিখতে লিখতে চলে আসে
যেহেতু আমার জানা আছে_ নরখাদক, নিশাচর রাক্ষস
কীভাবে ভালোবাসে?
লিখতে লিখতে, রাক্ষসের সঙ্গে আলাপ হলো। বন্ধুত্ব হলো।
কারণ, আমি তো গোত্রচূ্যত, মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েও
আমিও রাক্ষস হতে চলেছি_ নিহিত কারণ, এক রাক্ষুসীকে ভালোবেসে
ঘ.
মনোকষ্ট ছাপা হয় রেজিস্টার্ড প্রেসে
না-লেখারা নেচে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়, ভেসেদদ্রু বিনাশের পুতুলবউ0%গড় রেটিং:রেটিং :সা লে হা চৌ ধু রী
ফোরটিন ডাউন আর থার্টিন আপে দাদের মলম বংশানুক্রমিকভাবে বিক্রি করে মহিম বিশ্বাস। ওর বাবা সুখেন বিশ্বাস, তার বাবা হরিহর বিশ্বাস, এবং তার বাবা পুরোহিত বিশ্বাস। আসলে পুরোহিত বিশ্বাসের নামটা ছিল অন্য একটা। কিন্তু স্বপ্নে যখন এই দাদের ওষুধ সে পেয়ে গেল তখন নাম বদলে পটল হোড় পুরোহিত করল তার নামটাকে, সেই সঙ্গে হোড় বদলে বিশ্বাস। দাদের পুরোহিত। টুলো পণ্ডিত ছিল এককালে তাই দাদ না বলে বলেছিল দদ্রু। আর বিনাশ করে যে ওষুধ তার নাম দিয়েছিল দদ্রু বিনাশ। তখন অবশ্য থারটিন আপ অনেক দূর যেত। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি। একবার পটল হোড় দাদের মলম বেচতে বেচতে দার্জিলিং গিয়েছিল। এসব অবশ্য মহিমের শোনা কথা। আজকালকার ট্রেন এতদূর যায় না।
মহিমকে ট্রেনের সকলে চেনে। আসলে না চিনে উপায় কী? যে ক'জন ট্রেনের গতিতে জীবনযাপনের রসদ সংগ্রহ করে তাদের ট্রেনের যাত্রীরা চিনবে না, এমন তো হতে পারে না। তানসেন গুলি, শিশিমালতি, উকুনের তেল, ছারপোকার ওষুধ, নিমের মাজন, দাঁতন, ক্রিমির ওষুধ, দাঁত ফকফকা করবার মলম, কতসব প্রয়োজন থাকে বেঁচে থাকতে গেলে। এখন মহিমের যাত্রার গতি শান্তাহার থেকে পার্বতীপুর। না হলে চিলাহাটি। তবু সকলেই চেনে ওকে। প্রত্যেক স্টেশনেই চেনা লোক আছে ওর। এই সবের ভেতরেই ওর ঘোরাফেরা। পাঁচবিবিতে একটা ছোট বাড়ি আছে মহিমের। কলাবন নামের গাঁয়ে। ওই বাড়িটা কলাগাছের বাগানের ভেতর। বাপ-দাদার কাছ থেকে পাওয়া। পুরো বাড়িটা মহিম পায়নি। পেয়েছে কিছুটা অংশ, তাতেই চলে যায় ওর। সেই কিছু অংশের একটু খানি আবার ও ভাড়া দিয়েছে। সংসার ছোট মহিমের। তিন বছর হলো বিয়ে করেছে। চিংড়ি পোনা কিছুই এখনও ওর সংসারে আসেনি। অতএব সংসারে ওরা মানুষ দু'জন। বাপ-দাদার পুরনো চিৎকারটাই গাড়ির দুলুনিতে দুলতে দুলতে বারবার বলে ও _ দদ্রু বিনাশ চাই! ও দাদা দিদি, মাসি মেসো, কাকা কাকিরা দদ্রু বিনাশ চাই? লজ্জা পাবেন না দিদি-দাদারা, মাত্র একবার কি দুইবার প্রয়োগ তারপর ও জ্বালার চিরতরে বিনাশ। আমার দাদার পিতামশায় স্বপ্নাদেশে ওষুধটা পান। তারপর থেকেই আমরাও ওষুধ মানবসেবায় ব্যয় করছি। নামমাত্র মূল্য। কাজ না করলে দ্রব্য ফেরত। এসবই বারবার মিহি সুরেলা গলায় বলতে থাকে মহিম। ওর চেহারাটাও টুলো পণ্ডিতের মতো। মুখটা বেশ ফর্সা। বেশ একটু তেলতেলে ভাব আছে। পান খাওয়া ঠোঁট দুটো লাল। পান খেলে মেয়েলি ঠোঁটটা টুকটুকে হয়ে ওঠে। গলার স্বরটা যখন দূরের যাত্রীরা শুনতে পায় না ট্রেনের শব্দে, গলাটাকে বেশ উঁচুতে তোলে ও। বলে সে_ জীবনে শান্তি আনুন দিদিমা-কাকিমারা। লজ্জা পাবেন না। কেবল মহিম বিশ্বাসকে বলুন এরপর চিরশান্তিতে বাস করুন। মা, দিদিমা, কাকিমারা নিজে কখনও কেনে না। স্বামী বা সঙ্গের মানুষটাকে একটু গুঁতো দিয়ে বলে_ এক শিশি কেনো তো। শায়া পরতে পরতে কোমরের কাছে দাদের মতো কী যেন দেখলাম। সে খবর সঙ্গের মানুষ জানেন না তা নয়। যদিও আজকাল ইলেকট্রিক থাকে না, কেরোসিনের দাম অনেক, মোমবাতি কেনার পয়সা থাকে না, আর রাতের অন্ধকারে কোথায় দাদ কোথায় ঘা কোনো স্বামী খেয়াল করে? তবু গুঁতো খেয়ে তারা নড়েচড়ে বসে মহিমকে ডাকে। এরপর যখন আসে তানসেন গুলি আর শিশিমালতি সেগুলোর জন্যও বায়না ধরে তারা। আসে তিলেখাজা আর গজার কাচ বাঁধানো দোকান। এসবের ভেতর মহিমের বিক্রিবাট্টা ভালোই বলতে হয়। হবে না কেন? বংশানুক্রমিক সুনাম ওদের। এঁদো, জলে, ডোবায়, খালে, বিলে, গোসল করতে করতে দাদ হয়ে যায় অনেকের। তারপর এক গামছা থেকে, এক চাদর বা কাঁথা থেকে, না হলে স্বামীর কাছ থেকে বউ, বউয়ের কাছ থেকে স্বামী পেয়ে যায় এইসব চিত্রিত প্রেম। ফলে মহিমের পশার ভালো।
সারাদিন ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বাড়ি আসার আগে পাঁচবিবির বাজারটা ঘুরে আসে। সারাদিনের কামাইয়ের পয়সা দিয়ে বেশ কিছু জিনিস কেনে বউয়ের জন্য। বউয়ের জয়াবতি নাম ধরে মহিম ডাকে না। একেবারে বিগলিত ব্যানার্জি বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে মিহি সুরেলা গলায় বলে_ কৈ আমার পুতুল কোথায় গো? আমার পুতুলবউ কোথায়?
জয়াবতি ঘর থেকে বেরোয়। বেশ সাজগোজ তার। মাথায় খোঁপা। সেখানে রাজ্যের ফুল, পাখি, প্রজাপতি। যেন খোঁপা বাঁধা মাথা নয়, ফুলের বাগান। কী এক বিশেষ সুবাসিত তেল কিনে দেয় মহিম, পুতুলবউ যখন মাথায় মাখে নেশায় মহিমের দু'চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। কপালে বেশ বড় আর জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ। ঠোঁট শিশিমালতিতে টুকটুকে। পাতা পাতা ছাপা শাড়ি না হলে ফুল ফুল শাড়ি। না হলে চোলি ঘাগরা। একটা জমকালো লেহেঙ্গাও আছে ওর। গাল রুজে লাল। পুতুলবউ যখন পায়ে একটা রুপোর ঝুমুর বেঁধে ঝুম ঝুম করতে করতে আলো-আঁধারে মহিমের সামনে এসে দাঁড়ায় মহিম আবার জেনে যায় এমন একটা দৃশ্যের জন্য সারাদিনের প্রতীক্ষা ওর। একটা হালকা সস্তা সেন্টের গন্ধ থাকে শরীরে। ঘাগড়া বা শাড়ি যা-ই পরে সবগুলোর রংই উজ্জ্বল। টকটকে লাল, গোলাপি না হলে কমলা বা সবুজ।
দোকানটা নামানো হয়েছে এবার সে বউকে ধরে। বউটা তিন বছর পার হলেও ওর বাড়াবাড়িতে একটু লজ্জা পায়। চোখ নামায়। তখন জোড়া ভুরুটা পাখি হয়ে মহিমকে সুখের কথা বলে। ভাবে_ এত রূপ এত রূপ! আর এই মেয়ে আমার? আমার বউ? আর কারও নয়।
_হ্যাঁগো পুতুলবউ সারাদিন তুমি কী করলে গো?
পুতুলবউ উত্তর করে না। তারপর মুখটা একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে_ কাজ।
_ আহা কাজ কেন গো? কেন তুমি কাজ করতে যাও? হাত দুটোকে শক্ত করলে চলবে কেন? এমন নরমই রাখতে হবে। ঘরের কাজগুলো আমার জন্য রেখে দিও। আমি এসে সব করে ফেলব। এই বলে পুতুলবউয়ের হাতে ক্রিম ঘষে মহিম। পুতুলবউ কথা বলে না। তারপর আজ যা সে এনেছে একে একে মেলে ধরে বউয়ের চোখের সামনে। বলে_ নাও। বাজার ঘুরে এগুলো এনেছি আজ। কয়েক পাতা রঙিন ক্লিপ, কয়েক জোড়া কানের দুল, লাল গোলাপি ফিতে, চুড়ি, ঠোঁট পালিশ, নখ পালিশ এমন নানা ঝুটমুট। সবগুলো চলিল্গশ পাওয়ারের বাতির নিচে ঝিকমিক করে ওঠে। পুতুলবউ এবার জমানোর বাক্সটা আনে। তারপর সে একেবারেই ভুলে যায় মহিমের কথা। সবগুলো নেড়ে চেড়ে গুনে দেখে। বোধহয় ছত্রিশ জোড়া কানের দুল, হাজার রকমের হাজার রঙের টিপ, ঝুমঝুমির মতো খোঁপার কাঁটা, ভুরু আঁকার কালো পেন্সিল, শিশিমালতির মুখ বন্ধ ছোট শিশি, সস্তা সুরভি। গুনছে সাজাচ্ছে। মহিম একটু হাসে। খুশিতে তার বুকটা টনটন করে। এই পুতুলটা আমার। আহা সারাদিন একা থাকে। তখন জয়াবতি একটার পরে একটা খোলে আর মহিম সব ভুলে এসব দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। জয়াবতি মহিমের এমন ভালোবাসায় অভ্যস্ত। ভাবে, হয়তো সব স্বামীই এমন করে। অবশ্য পাশের লুৎফার গল্পটা অন্যরকম। যেখানে জয়াবতির গল্প মেলে না। সে ভাবে সব স্বামী বউয়ের পায়ে আলতা পরায়, হাতে ক্রিম ঘষে, খোঁপায় ফুল পরায়। এসব নিয়ে ব্যস্ত জয়াবতি এক সময় বুঝতে পারে বাইরের বারান্দার কেরোসিন কাঠের টেবিলে মহিম খাবার সাজিয়েছে। এবং এক সময় দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে_ ও পুতুলবউ খাবে এসো। যে লোক সারাদিন ট্রেনে ট্রেনে গলাবাজি করে বাড়ি এসেছে তারও যে কিছু সেবার প্রয়োজন সে কথা ভাবতে দেয়নি মহিম। ফলে পুতুলবউ সে নিয়ে আর ভাবে না। মাছের ভাজা, পটোল ভাজা, ঘন ডাল, কখনও মুরগি এইসবই বউকে খাওয়ায় মহিম। বউটাকে সুখে রাখতে কী-না করে মহিম। খাওয়া আর বউয়ের জন্য কেনাকাটা এ ছাড়া তেমন খরচ নেই। লুৎফা আর তার স্বামী বাড়ির যে অংশটা ভাড়া নিয়েছে সে জন্য কিছু টাকা পায় মহিম। _আর একটু খাও। আহা না খেলে চলবে কেন? গায়ে গতরে শাঁস মাস লাগছে না কেন বল দিকি? জয়াবতি উত্তর দেয় না।
আর খাবার পর থালা-বাটি-গল্গাস ধুয়ে যখন ঘরে আসে মহিম দেখে জয়াবতি হীরামতি একমাত্র বেতের চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। বাতির আলোতে তার ঝুটমুট দুল ফুল হীরের মতো ঝিকমিক করছে। তার পরনে বিশেষ ঘাগড়া আর চোলির মতো বল্গাউজ। যার মাঝখানের বোতাম খোলা। বুকের একটু নরম ঢেউ চোখে পড়ে। তবে বুকের নরমে নয়, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মহিম। হাতের দিকে এবং পা দুটোর দিকে। পায়ে আলতা পরেছে জয়াবতি। জানালার ওপারে কলাগাছের ভেতর চাঁদের আলো। আর ঘরের ভেতরে আর এক পূর্ণিমার চাঁদ। কী এক পাখি ডাকে। ঝিঁ ঝিঁ আর ঝিলিল্গর রব। জয়াবতির কাজল পরা ঘুম ঘুম চোখ। টুলটা টেনে কাছে এসে বসে মহিম। তারপর তাকায় বউয়ের মুখের দিকে। ঘুম ঘুম মুখটার ভাঙাচোরা রং ঠিক করে জামার হাতায় না হয় রুমালে। জয়াবতি হাই তুলতে তুলতে বলে_ ঘুম পাইছে গো। বউকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয় মহিম। বউটা ততক্ষণে ঘুমে বালিশ হয়ে গেছে। মশারির ধারগুলো সযতনে গুছিয়ে দেয়। বউকে মশা খাবে এমন ভাবনায় বুকে ব্যথা হয় মহিমের।
কিন্তু মহিম তখন ঘুমায় না। এবার তার পরদিনের দদ্রু বিনাশের প্যাকেটগুলো ঠিক করার সময়। আজ যা উপার্জন হলো তার হিসাব করে। তারপর একটা টিনের বিস্কুটের বাক্সে কিছু রেখে দেয়, সেটাকে লুকিয়ে রাখে। এই সঞ্চয়টার কথা সে কখনও তার বউকে বলে না। কারণ? ইচ্ছেটা এমন ঝুটমুট নয় টাকা জমিয়ে সে বউকে আসল সোনার গয়না গড়িয়ে দেবে। আর্মলেট, সীতাহার। বউ এসবের কিছু জানে না। এরপর আর একটা বাক্সে কিছু ভাংতি পয়সা রাখে যেটা ওর বউয়ের সারাদিনের খরচের জন্য। আর একটা বাক্সে কিছু টাকা। সেটা যে কেন রাখে ঠিক জানে না। মনে হয় বত্রিশের মহিম যখন বাষট্টি হবে সেদিনের কথা ভেবে।
কলাপাতার ফাঁক দিয়ে একটু আলো এসে পড়েছে জয়াবতির মুখে। মশারির পাশে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ সে দৃশ্য দেখে। তারপর কলপাড়ে গিয়ে ভালোমতো হাত-পা-মুখ ধুয়ে, কাপড় বদলে বউটার পাশে টুক করে শুয়ে পড়ে। একটা ঘুমন্ত হাত দদ্রু বিনাশের মহিমের গলায় পড়ে। আর একটা হাত বুকে। দুই হাতেই চুমু খায় মহিম। বলে_ ঘুমোয় গো জয়াবতি। রাত জাগলে শরীর খারাপ হবে গো তোমার।
তবে এক একদিন বাড়িতে এসে সারাদিনের গল্প করে মহিম বউয়ের সঙ্গে। _ জানো পুতুলবউ এক দিদিমণি আজ একসঙ্গে পাঁচ প্যাকেট কিনেছে গো। শায়া পরতে পরতে কোমরে ঘা। ঘা নয় দাদ। কত প্রকার দাদই যে হয় কোনোটা সিকি পয়সার সমান, কোনোটা টাকার সমান, কোনোটা গোল, কোনোটা তিনকোনা। যেন ভারতবর্ষের মানচিত্র হয়ে ফুটে আছে মানুষের শরীরে। বর্ণনা শুনে ঝিনুকের বোতামের মতো দাঁত দেখিয়ে জয়াবতি খিল খিল করে হাসে। মহিম বলে_ তোমার শরীরে ওসব কিছু হবে না। আমরা এতদিন কারবার করছি কখনও ও জিনিস আমাদের ছোঁয়নি। স্বপ্নে দাদের দেবী বলেছিলেন হরিহোড় পুরোহিতকে _ ও অসুখ তোমাদের ছোঁবে না, ব্যবসা কর, ভয় করবে না। ও দেবী হলো মা শিতলা আর ওলার তিন নম্বর বোন শিবা। বেশ কিছুক্ষণ একটা বানানো দেবীর গল্প করে মহিম। হাঁ করে শোনে জয়াবতি। এক সময় কথা শুনতে শুনতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়_ হাতির মতো বড় বড় পা ফেলে মন্তাজ মিস্ত্রি কোথায় যেন চলেছে। বেশ বড়সড় একটা মানুষ। সকলেই চেনে মন্তাজ মিস্ত্রিকে। হাতির মতো বল, বাঘের মতো থাবা আর সিংহের মতো রাগ। বড় বড় গোঁফ। আর কেমন রাগি রাগি চেহারা। জয়াবতি অনেকবার দেখেছে এই সিংহের মতো মানুষটাকে। তবে একেবারে দরকার না হলে কেউ কখনও মন্তাজের আশপাশ যায় না। দরকার হলে একজনকে দুরমুশ করতে পারে।
_তোমাকে একটা ভালো টকি দেখাব পুতুলবউ।
_ টকি? কবে?
_ এই তো সামনের রবিবারে।
রোববারে অর্ধেক দিন কাজ করে মহিম। জয়াবতি খলবল কণ্ঠে বলে_ তাহলে সেদিন যে লাল ঘাগড়া আর চোলি এনে দিয়েছো সেটা পরব।
_ না না পুতুলবউ তুমি শাড়ি পরবে। বালুচরী। খুব মানায় তোমাকে। আর গলায় দেবে বড় মটরমালাটা। আর কানে ঝুমকো। জয়াবতি মাথা নাড়ে। সে সত্যিই অনেক দিন কোনো সিনেমা দেখেনি।
রাতে ঘুমোতে এলে জেগে থাকা জয়াবতি মহিমকে কাছে টানে। মহিম তেমনি মিহি মসৃণ গলায় বলে _ ঘুমাও গো বউ। ঘুমোলে তোমার মুখটা ফুলকো লুচির মতো কেমন ফুলো ফুলো হয়। এই বলে জয়াবতির গায়ে বাতাস করে। শরীরে একটু হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর সারাদিনের ক্লান্ত মহিম এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালবেলা জয়াবতি আগেই ওঠে। কলতলায় গিয়ে হাত-মুখ ধোয়। মহিম ওঠে খানিক পরে। চিঁড়ে মুড়ি কিছু একটা খেয়ে বেরিয়ে পড়বে এবার। আজ সে থার্টিন আপে চিলেহাটা পর্যন্ত যাবে। সোনার সেটটা খুব তাড়াতাড়ি বানাতে হবে। এইসব ঝুটমুট মটরমালায় কি রানীর মতো জয়াবতিকে মানায়? যে মেয়ের রানী হওয়ার কথা সে কি-না আজ মহিমের বউ? মহিম এমন ঘটনায় বড়ই বিস্মিত। মনে মনে বলে_ এমন একটা ঘটনা কি ঘটে জগৎসংসারে? যে রানী হয়ে প্রাসাদে বাস করবে সে কি-না দদ্রু বিনাশ মহিমের ঘরে। তখনই পাউডার ছিটানো, সুরভি স্প্রে। বলে_ ভেব না পুতুলবউ, আমি তোমাকে রানীর মতো যত্নে রেখে দেব সারাজীবন। একেকদিন পুতুলবউ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে_ রানী হতে কে চায় গো?
মহিম চলে গেলে ঘরদোর তাকিয়ে দেখে। বিছানাটা টান টান করতে গিয়ে কী ভেবে চাদরটাকে লাথ্যি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেয়। ঘরের মাঝখানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে বাসি চাদর। স্নানের জল গায়ে ঢালে বালতি বালতি। মনে হয় গায়ে ওর জ্বর আসবে। ঘরে ফিরে আয়নায় মুখ দেখে। মুখ পালিশ হয়, ঠোঁটে রং মাখে। চুলগুলো পেছনে ঝুলছে। রাশি রাশি কাকের পাখার মতো কালো চুল। ব্রা পরতে গিয়ে মনে হয় ব্রার সাইজটা আগের মতোই আছে। লুৎফার ব্রার সাইজ এখন আগের চাইতে অনেক বড়। লুৎফা মুখ লাল করে বলেছিল সে কথা। এসব ভাবছে দেখে হন হন করে মন্তাজ কোথায় যেন চলেছে। মন্তাজ একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিজের গাঁয়ের মেয়েদের সে কখনও কু'চোখে দেখে না। এই কারণে মন্তাজকে কেউ কিছু বলে না। ঘরের দিকে তাকায় জয়াবতি। মাদি কুত্তার মতো একটা দলা পাকানো চাদর। সেটাকে আর একটা লাথি দিয়ে ঘরের এক কোণে পাঠায়। মহিম সময় পেলে কাল এটা ধুয়ে ফেলবে। ও আলমারি থেকে একটা লাল চাদর টেনে নামায়। বিছায়।
তারপর তার হাজার জিনিসের বাক্স ঢেলে আবার নতুন করে সাজায়।
আজো আরও কিছু আনবে। জিনিসের সংখ্যা বাড়বে। আগে রাখত একটা ছোট বাক্সে। এখন তিনখানা বাক্স। কতগুলো শাড়ি আছে যার ভাঁজ আজো খোলেনি। কতগুলো চোলির ফিতে আজো বাঁধা হয়নি। কিছু ঝুটমুট গয়নাগাটি সাপের মতো ঠাণ্ডা শরীরে জয়াবতির গায়ের গরমের অপেক্ষায়। জয়াবতি ঠাণ্ডা মাটির সোরাই থেকে তিন গল্গাস পানি পান করে। লুৎফা একবার এসে গল্প করে যায়। জয়াবতি ওর সব কথা ঠিক বুঝতে পারে না।
ও দিদিমণিরা লজ্জা পাইবেন না। দদ্রু বিনাশ কিনে নেন। সব ঠিক হয়ে যাবে গো সব সেরে যাবে। স্বামী বেশি বেশি ভালোবাসবে। ওর কথার ধরনে ফিক করে হাসে দু'একজন। একটা বউ প্রথমবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে চলেছে_ সোনার মালা আর কানবালা পরে। সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মহিম। মনে মনে ভাবে_ আমি যদি প্রশ্ন করি সেটটার দাম কত বউমণি কী বলবে? অবশ্য জয়াবতি বলেছে_ বাড়িতে শক্ত দরজা জানালা নেই, চোর এসে সব নিয়ে যাবে। দামি জিনিস রাখার মতো মজবুত বাড়ি নয় তোমার।
_ তুই আমার সবচাইতে দামি জিনিস। তোর চাইতে দামি আমার আর কিছু নাই।
_ কী কও তুমি। আমারে চোর নিবে না। আমি মেয়েমানুষ। ট্রেনের বউটার সামনে দাঁড়িয়ে সেসব ভাবছে মহিম। উত্তরে বলেছিল_ সেগুন কাঠের জানালা-দরজা নাই। জানালায় মোটা শিক নাই। তুই একটু সামলে সুমলে চলিস পুতুলবউ। তোর শরীরে রানীর মতো রূপ। তুই রানী হবি।
_ কে কইছে তোমারে আমি রানী হবো।
_ আমি জানি।
_ যাত্রা দলের রানী?
_ নাগো পুতুলবউ সত্যিকারের রানী।
জয়াবতি ঘুমিয়ে গেছে বালিশ হয়ে। ঘুমানোর আগে বলেছিল_ রানী হতে গেলে রাজা লাগে, আমার রাজা কই?
একটা যুৎসই উত্তর দিতে পারেনি মহিম। মাথায় একটা শোলার মুকুট পরলে সেকি রাজা হতে পারবে? কিন্তু জয়াবতি নিশ্চয়ই একদিন রানী হবে।
_ এই দদ্রু বিনাশ, এমন হাঁ করে কী দেখ তুমি। ভাগো। আমার ওসব দাদ ফাদ নেই।
মহিম তাড়াতাড়ি সরে যায়। এমন হাংলার মতো দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হয়নি।
জানালার ওপারে চলমান পৃথিবী। গাছগুলো সরে যায় বাড়িগুলো সরে যায়। একটা খালি বেঞ্চে বসে টাকা গোনে। পয়সা সিজিল মিজিল করে। আজ লেবু লজেন্সটা খুব চলেছে। সে ওই দাদের কৌটার পাশে কিছু লেবু লজেন্স রেখে দেবে। এদিকে ব্যানার্জিভাজাও বেশ চলছে। সে জানে কী করে মুখরোচক চানাচুর বানানো যায়। সেও তো বিশ্বাস, ভাজা রাখতে পারে দদ্রু বিনাশের পাশে। তাহলে বউয়ের রানী হতে আর কয়দিন?
রোববারে বউকে টকিতে নিয়ে যাবে।
ঘরে ফিরে বউয়ের পায়ে আলতা পরায়। কাঠির মাথায় তুলো পেঁচিয়ে। সুড়সুড়িতে বউটা হেসে ওঠে। বলে মহিম_ তোর পা নয় যেন পদ্মরে জয়াবতি। এই নামে সে কখনও ডাকে না। আজ সে ডেকে ফেলল। এই বলে পায়ে যখন চুমু খায় জয়াবতি পা দুটো সরিয়ে নিয়ে বলে_ এ তুমি কী কর গো দাদের মলমের রাজা। আমার পাপ লাগবে না তুমি পায়ে চুমু খেলে?
না লাগবে না। তোর পা দুটো বুকের ভেতর নিয়ে হৃদয় জুড়াইরে পুতুলবউ।
পুতুলবউটাকে জীবন্ত পুতুল বানিয়ে টকিতে আসে মহিম। লাল বালুচরীর ফাঁকে তার জ্বলজ্বলে মুখটা চেয়ে দেখবার মতো। দু'হাতে জনতাকে ঠেলে বউকে টকির ভেতরে আনতে পারে। বেশকিছু মানুষ চেয়ে দেখছে জয়াবতিকে। এর মধ্যে বড় বড় গোঁফের মন্তাজ মিস্ত্রিও। জয়াবতি মন্তাজ মিস্ত্রির দিকে তাকিয়ে একটু ফিক করে হাসে। মন্তাজের চোখের পলক পড়ে না।
একটা রিকশা ডেকে বাড়িতে ফেরে দু'জন সিনেমা দেখা শেষ করে। পেছনে একজন ফলো করছে তাদের সে খবর ওরা জানে না। বাড়িতে ফিরে আজ আর খেতে হবে না। লুচি, চমচম, আলুর দম, মিষ্টি, আইসক্রিম। একেবারে এলাহি কারবার। তারপর গালভর্তি মিষ্টি পান।
বউটা টান টান চাদরে শুয়ে বলে_ কইগো কোথায় গেলে গো। ঠিক এমন করে শুয়েছিল নায়িকা। শ্রীদেবী। মহিম বলেছে ও নাকি নায়িকার চাইতেও সুন্দর। চোলির বোতাম খুলে বাতাস খায় জয়াবতি। শায়াটা একটু উপরে তোলে। মহিম বলে মিহি স্বরে_ হাতের কাজ শেষ করে আসতেছি গো পুতুলবউ।
তারপর যখন হাতের কাজ শেষ হয় রাত অনেক। কালকেও চিলাহাটি পর্যন্ত যেতে হবে তাকে। ওখানে নাকি দাদের মড়ক লেগেছে। লজেন্সওয়ালা বলেছে গতকাল। বলেছে খুশি খুশি গলায়_ মহিমদা তোমারে সবাই খোঁজ করছিল। সে সহব্যবসায়ীর ভবিষ্যৎ সাফল্যে ভয়ানক খুশি। এক ফাঁকে সেই লুকানো টাকার টিনটা বের করে। মন খারাপ হয়। গলার মালা নয়, কেবল নাকের ফুলের টাকা হয়েছে মনে হয়। দুলও একটা হতে পারে টেনেটুনে। হবে একদিন হবে। হে শিতলা ওলা দেবীর বোন শিবা এমন মড়ক আরও লাগাও তুমি।
ঘুটঘুটে অন্ধকার, জয়াবতি বিছানার দু'পাশে দু হাত রেখে, দু'পা দু'পাশে মেলে দিয়ে চোলির বোতাম খুলে ঘুমিয়ে আছে। খুব সাবধানে বউয়ের পা গুছিয়ে দেয় মহিম। একটু ওস পড়ে বলে অগ্রহায়ণের রাতে বউয়ের গায়ে একটা কাঁথা চাপায়। তারপর অভ্যাসে আবার একটু পাখার বাতাসও করে। মহিম এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। আগুন বুকে জয়াবতি চোখ মেলে তাকায় আগুনের হলকায়। সে ঘুমায়নি। শ্রীদেবী অপেক্ষায় ছিল।
কয়েকদিন পর বাড়িতে ফিরে জয়াবতিকে খুঁজে পায় না মহিম। লুৎফাকে ডাক দেয়। বলে_ তুমি জানো নাকি লুৎফা ও কোথায়?
অনেক পরে বলে লুৎফা_ কাকা দুইদিন আগে মন্তাজ মিস্ত্রিকে এই বাড়িতে দেখেছিলাম।
_ কাকে? ফ্যাকাশে মুখে প্রশ্ন করে দদ্রু বিনাশ মহিম।
_ মন্তাজ মিস্ত্রিকে কাকা।
_ মন্তাজ? কী দেখেছো তুমি লুৎফা?
_ তেমন কিছু না কাকা। খালি মন্তাজরে।
_ আর কিছু? বারবার প্রশ্ন করে মহিম।
_ আর কিছু কইতে গেলে গুনাহ।
_ কিসের গুনাহ রে লুৎফা? ক' তাড়াতাড়ি আর কী দেখেছিস?
মাটির দিকে তাকিয়ে বলে লুৎফা_ দেখেছি মন্তাজ জয়াবতি কাকির চোলির ফিতে বেঁধে দিচ্ছে।
_ বাঘের মতো মন্তাজ? ও তো একটা কসাই। যাকে বলছে সে তখন ঘর থেকে চলে গেছে।
রাজা নয়, মন্ত্রী নয়, কোটাল নয়, নাজির উজির নয়, মন্তাজ?
লুকানো টাকা এবং বাষট্টি বছরের পেনশনের জন্য জমানো টাকা সব নিয়ে চলে গেছে জয়াবতি। যে টাকার খবর পুতুলবউয়ের জানবার কথা নয়। বউ ঘুমিয়ে গেলেই তো এসব হিসাব-নিকাশ করত ও।
এখনও দদ্রু বিনাশ মলম বেচে মহিম। ট্রেন থেকে ট্রেনে। বাঘ-সিংহ-হাতির সঙ্গে যে পুতুলবউ চলে গেছে তার কোনো খোঁজ পায়নি ও। মন্তাজ তাকে রেখেছে না চড়া দামে বিক্রি করেছে সেটা মহিম কী করে জানবে। কোনো সুন্দরী গয়না পরা মেয়ে দেখলে সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ভাবে মালার দাম কত হবে? বাড়ির টিনে কাক কা কা করে। মহিম হিসাব মেলাতে পারে না। কলতলায় গিয়ে মাথা ধোয়। পুতুলবউয়ের মালা, চুরি, ঝুমকো বিড় বিড় করে দদ্রু বিনাশের মহিম। স্বপ্নে পাওয়া চার পুরুষের মলম। আর কেউ নেই জাত ব্যবসাটা বুঝে নেয়। বাপ-দাদার নাম রাখে। ভিটেতে বাতি জ্বালায়।
থার্টিন আপ আর ফোরটিন ডাউন এখন পারাবত আর পিয়ারী নামে চিলাহাটি যায় এবং শান্তাহারে ফিরে আসে।শেষ ভোজ0%গড় রেটিং:রেটিং :তু ষা র ক ণা খো ন্দ কা রঅলংকরণ : গুপু ত্রিবেদী
রাতের নির্জনতায় কম্পিউটার বন্ধ করার সামান্য শব্দ কানে ঝ-ম্ করে বাজে। যন্ত্রটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে মেইলগুলো আর একবার দেখা দরকার ছিল। স্রেফ মেইল পড়ার আলসেতে দরকারি কোনো কাজ ঝুলে গেলে নিজের ওপর খুব বিরক্তি আসে।
তবুও এখন যন্ত্রটা আর একবার খুলে বসতে ভালো লাগছে না। দরকারি কাজ ঝুলে গেলে যাক। ইদানীং কাজের বোঝা ঝপ করে ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলে মুক্ত মানুষ হতে খুব ইচ্ছে করে। এ ইচ্ছাটা সচেতন নিয়ন্ত্রণের বাইরে জবরদস্তি ঘন ঘন আমার মনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। আমি কর্মাসক্ত_ কাজ বিনে বেঁচে থাকা অসম্ভব এই অনুভূতিটা আমার মনের ওপর এখন একটা বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বোঝাটা শিগগির হ্যাঁচকা টানে মাথা থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে।
রাত কত হলো? ঘাড়-পিঠ-কোমরজুড়ে হালকা চিনচিনে ব্যথা। শরীরজুড়ে ক্লান্তিকর অবসাদ। এখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলে বেশ আরাম হতো। শরীরে বাড়াবাড়ি অবসাদের সঙ্গে ঘুমের বিরূপ লাগালাগি। বিছানায় শুয়ে ঘুমের আশায় জেগে থাকা সেটা আরও বিরক্তিকর।
মাঝরাতে রাতজাগা কুকুরের ডাক শুনতে আমার খারাপ লাগে না। আমার সঙ্গে আর কেউ জেগে আছে ভেবে বরং আরাম লাগে। পশ্চিমের বারান্দায় বিছিয়ে পড়া আলোটা কি ফ্যাকাশে জ্যোৎস্না নাকি রাস্তার বাতির আলো? এখন কারেন্ট চলে গিয়ে ঝপ করে সব বাতি নিভে গেলে ঠিকঠাক জানা যেত এটা আলো না জ্যোৎস্না। এমন নির্জন আলো-আঁধারের দিকে চেয়ে থেকে সম্ভব-অসম্ভবের মিশেল দেওয়া আর একটা স্বপ্ন একটুক্ষণের জন্য মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। আঁধার রাতে ঝোপের ওপর জোনাকির জ্বলা-নেভা দেখতে একবার একরাতের জন্য গ্রামে যাব। ভাদ্দরের মেঘলা সন্ধ্যায় সেদিন একটু আগে আগে আঁধার নামবে। আঁধার ঘন হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের গায়ে থোকা থোকা জোনাকের গায়ে নরম আলো জ্বলবে-নিভবে। দৃশ্যটা মনে ধরে গেলে দুইরাত-তিনরাত কিংবা অনেক রাত-দিন গ্রামেই রয়ে যাব।
ভাদ্দরের সন্ধ্যায় থোকা থোকা জোনাক দেখার ক্ষুধা মাথার মধ্যে একটানা জ্বলছে-নিভছে। আমার মুঠোর মধ্যে গল্গাসের ভেজা গা ঘিরে এক থোকা জোনাকির ছন্দায়িত নাচ। মদ, জ্যোৎস্না আর জোনাকি এই তিনটার মধ্যে হঠাৎ এই মাঝরাতে দারুণ আবেগমাখা মাদকতা খুঁজে পাচ্ছি। গল্গাসটা আর একবার ভরে নেওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে ঘরে মোবাইল ফোনের ডাকাডাকি।
দুনিয়ার এক কোনায় যখন মাঝরাত আর এক কোনায় তখন ফটফটে আলোভরা ভরদুপুর। এককালে ব্রিটিশের রাজত্বে সূর্য ডুবত না, এখন বহুজাতিক কোম্পানির রাজ্যে সূর্য সারাক্ষণ মাথার ওপর জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করার বেলায় এটাই একটা বড় জ্বালা। এখানে কোনোদিন রাত-দিনের হিসাব মেলে না। ফোনটা কানে ছোঁয়াতে ওপাশে ফ্রাঙ্কের গলায় ঝাঁঝাল বিরক্তি, 'তোমার সমস্যা কী? মেইল চেক কর না? দুই-দুটা মেইল পাঠিয়ে জবাবের আশায় বসে আছি।'
_দাঁড়াও। দেখছি। মোটে দুই ঘণ্টা মেইল চেক করিনি। এর মধ্যে তোমার মাথায় আসমান ভেঙে পড়ার মতো কী এমন ঘটনা ঘটে গেছে?
_শোন, তোমার দেশে এখন রাতদুপুর।
_তথ্যটা মাথায় রেখে আমাকে ফোন করেছ কেন জ্ঞানপাপী? আমার ঘুমের সুখ মাটি করার কুমতলবে?
_শোন, খিটিমিটি করে সময় নষ্ট কর না। তোমার টিকিট বুক করা হয়ে গেছে। কাল সকালে ফ্লাইট। তোমার অবধারিত ধানাই-পানাই আশঙ্কা করে টিকিট বুকিংয়ের কাজটা আমি নিজেই অনলাইনে করে রেখেছি। কোম্পানির ড্রাইভারকে ফোন করার কষ্টটাও আমি স্বীকার করে নিয়েছি। জার্মানিতে এখন পঁচিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বাঘা গরম। ব্যাগ গোছানোর ঝক্কি থেকেও বেঁচে গেলে। আহা! তোমার কি সুখ। শোন গো সুখী নারী, ভোর ছয়টায় ড্রাইভার তোমার দরজায় বেল বাজাবে। কাল সন্ধ্যায় তুমি আমার সঙ্গে ফ্রাঙ্কফুর্টে ডিনার করবে। রাখি। বাই-ই।
চাকরির ব্যাপারে আমি মনোগ্যামিস্ট সতী নারী। পাক্কা দুই যুগ ধরে এই কোম্পানির জন্য প্রাণ-মন-দেহ উৎসর্গ করে বসে আছি। এখানে ফ্রাঙ্কের চাকরির বয়স আমার চেয়ে এক বছর বেশি। মাথার ওপর সিইও আর অ্যাকাউন্টসের আনেট্টা বুড়ি ছাড়া বাকি কারোরই চাকরির বয়স আমাদের ধারে-কাছে না। আমাদের ক'জনার জন্য এই চাকরি পেশার চেয়ে আরও বড় কিছু। সেই বড় কিছু শুধু নিজের ভেতর টের পাওয়া যায়। ওটি কোনো সচেতন ব্যাখ্যার ধার ধারে না।
দুনিয়াজোড়া পেশাদার পরিবেশবাদীরা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখন রাস্তায় সংশপ্তক। আমাদের কোম্পানিকে কফিনে না ঢুকিয়ে ঘরে ফিরবে না পণ করে ওরা রাস্তায় নেমেছে। কোম্পানির সবক'টি পণ্যের পেছনে ওরা গেল গেল রব ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওদের মরিয়া ভাব দেখে মনে হয় আমাদের সঙ্গে ওদের ব্যক্তিগত লাগালাগি। মিডিয়ার ঘায়ে আমাদের আফ্রিকার বাজার ধসে পড়ার পর এখন এশিয়ার বাজারও ভয়ানক টলমল। কীটনাশক নয়, আমাদের কোম্পানির লোগোটাই ওদের চোখে এখন মূর্তিমান প্রাণঘাতী বিষ। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই কোম্পানির বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় পরিবেশবাদীরা এখন একপক্ষের হাতে ধারালো হাতিয়ার। কোম্পানির দুর্দিনের খবর চাউর হতে অনেকে চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। যারা আছে তারাও রুটি-রুজির ধান্দায় নানা জায়গায় হানা দিয়ে ফিরছে।
'কীটনাশকের বাজারে আফ্রিকার নতুন অধিপতির পরিচয় জেনেছ ফ্রাঙ্ক? পরিবেশবাদীরা ওদের কাছ থেকে ভালো টাকা পাচ্ছে এ তথ্য সেদিন তোমরা মেনে নিলে আমাদের আজ এ বিপর্যয় হতো না। বিনা লাভে পরিবেশবাদীরা লোহা বয়ে বেড়াচ্ছে একথা আমি কোনোদিন বিশ্বাস করিনি।' কয়েক সপ্তাহ আগে আমার এমন সোজাসাপ্টা সিদ্ধান্তের জবাবে ফ্রাঙ্কের মারফতি জবান শুনে আমার পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল।
'তোমরা বাঙালিরা বড় বেশি সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত। ভালোমানুষদের মহৎ ভাবনার দিকে তোমরা সবসময় কপাল কুঁচকে তাকাও। দুনিয়াটাকে বাঁচানোর জন্য পরিবেশবাদীরা এমন ক্ষ্যাপা পাগল। দুনিয়া বাঁচানোর জন্য অবিরাম লড়াই চালাতে গেলে অর্থের অবিরাম উৎস লাগে। প্রচার বাণিজ্যের রীতি মেনে ওরা শাসালো স্পন্সর বাগিয়েছে? তাতে দোষের কী ঘটনা ঘটেছে। নাহক ওদের গাল দিয়ে সময় নষ্ট করা তোমার একটা বদ নেশা।'
জার্মানরা ভয়ানক ঘোড়েল। ওর কথাগুলো গালাগালি নাকি প্রশংসা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল সব ছাপিয়ে ফ্রাঙ্কের মনের মধ্যে ভিন্ন একটি কথা ছোপানো আছে।
এ সপ্তাহে দিলি্ল অফিসের কাজ সেরে আগামী সপ্তাহে আমার জার্মানি যাওয়ার কথা ছিল। ফ্রাঙ্কের তাড়া দেখে মনে হচ্ছে সমস্যা ভালো মতো ঘোঁট পাকিয়ে উঠেছে। কিন্তু আমি ফ্রাঙ্কফুর্টে হাজির হয়ে থানা গেড়ে বসে থাকলে সমস্যার কোনো হেরফের হবে! দুই যুগ ধরে তিল তিল যত্নে সৃষ্টি করা ব্র্যান্ডগুলোর অকালমৃত্যুতে আমার বুকে এখন চিনচিনে ব্যথা।
ভোর হয়ে এসেছে। গোছগাছ শেষ করে ডোর বেল বাজার অপেক্ষায় বসে আছি। আমার এমন তড়িঘড়ি দেশান্তরে যাওয়ার সঙ্গে আমার পরিবার অনেক বছর ধরে অভ্যস্ত। এজন্য আমার কোনো বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয় না।
গ্রীষ্মের লম্বা বেলায় সূর্য পাটে বসার এখনও অনেক দেরি। নিচে ঘন সবুজ পাইনের বন ছাড়িয়ে পেল্গন এখন রানওয়ে তাক করে ছুটে চলেছে। আর কি এমন বারবার এখানে ছুটে আসব? এত আপন একটা শহর থেকে এত বছরের আনাগোনার পাট এবার ঘুচিয়ে দিয়ে চলে যাব। বুকের মধ্যে ফের পুরনো ব্যথার মোচড়।
ফ্রাঙ্ক কি আজ আমাকে নিতে এসেছে? ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে ডানে-বাঁয়ে অনেকদূর চেয়ে দেখে অচেতন মনে খুব গোপন একটু হতাশা জাগে। সচেতন বুদ্ধিতে স্পস্ট করে বুঝি ফ্রাঙ্ক রাজ্যের কাজ ফেলে আমাকে নিতে এয়ারপোর্টে আসবে কেন? ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর কি আমার অচেনা নাকি আমি কচি খুকি যে হারিয়ে যাব? তবুও অকারণ মন খারাপ মন থেকে সরতে চায় না।
ট্যাক্সিতে বসে ফোনের সুইচ অন করার সঙ্গে সঙ্গে সেটি আচমকা বেজে ওঠে।
_তুমি কোন নরকে হারিয়েছ? তোমার ফোন বন্ধ কেন? আমি পার্কিং লটে। চলে এসো।
ফ্রাঙ্কের গলায় স্বভাবজাত ডয়েস ঝাঁঝ।
_আমি ট্যাক্সিতে। শহরের দিকে অনেকখানি পথ চলে এসেছি।
_ট্যাক্সির মুখ ঘুরিয়ে আবার এয়ারপোর্টে এসো। আমি তোমার জন্য নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
এত দাবি! মন থেকে মন খারাপ হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। গোছগাছ শেষে গাড়িতে বসতে ফ্রাঙ্কের পুরনো বুলি,
_সিটবেল্ট বাঁধ। তোমরা বাঙালিরা বড় ত্যাঁদড়। আইন মানতে চাও না।
ফ্রাঙ্কের মুখে এ কথা আগে অনেকবার শুনেছি। তবুও এখন হেসে গড়িয়ে পড়তে ভালো লাগে। প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি।
_তোমার কি বেশি মন খারাপ? চার চাকার মোটরযান উড়োজাহাজের স্পিডে চালাচ্ছ কেন?
ফ্রাঙ্কের মুখে ছিপি আঁটা। খানিক পরে খুব নিচুস্বরে ফ্রাঙ্ক স্বগতোক্তির মতো বলে,
_বেনিন অফিসে পরিবেশবাদীরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এ সপ্তাহে দিলি্ল অফিস গুটিয়ে নিতে হবে। আঙিনায় পুলিশ বসিয়ে আর যা-ই হোক ব্যবসা করা চলে না।
_ 'একে একে নিভিছে সকল দেউটি।'
_কিছু বলছ?
_নাঃ! বল ভগ্নদূত আর কী কী খারাপ খবর তোমার ঝুলিতে আছে।
ফ্রাঙ্ক কথার জবাব না দিয়ে অস্থির গতিতে গাড়ির ট্র্যাক বদলায়।
কথা বলতে ভালো লাগছে না। পৃথিবীজুড়ে সবখানে পরিবেশবাদীরা এখন জড় বুদ্ধির গোঁয়ার জনতা। ওদের কে বোঝাবে বেনিনের পাখিগুলো আমাদের কীটনাশকে মরেনি। ল্যাবরেটরি টেস্টের ফলাফলও আমাদের কীটনাশককে দায়ী করছে না। পশু-পাখির এমন মড়ক কি নতুন কিছু? ওরা প্রকৃতির নিয়মে অসুখের শিকার। প্রকৃতিবাদীরা ওদের সময়মতো ভালো কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির তৈরি ওষুধ খাওয়ালে নিশ্চয়ই পাখিগুলো বেঁচে যেত।
আজকের দুনিয়ায় কত হাজার পদের পণ্যের সঙ্গে মাখামাখি নিয়ে মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনের একটি উপকরণ বাদ পড়লে মানুষ তড়িঘড়ি সেটি কিনতে বাজারে ছুটবে এটাই স্বাভাবিক। পরিবেশবাদীরা কি জানে একটি পণ্যের পেছনে কত শত মানুষের তিল তিল শ্রম-ঘাম-মেধা জড়ানো থাকে!
_এই ফ্রাঙ্ক, পরগাছা পরিবেশবাদীরা ক্ষুধার্থ মানুষের জন্য মানববন্ধন করেছে এমন খবর কখনো তোমার চোখে পড়েছে?
ফ্রাঙ্কের মুখে কথার আকাল। বিরক্তিভরা চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে আবার সে রাস্তার দিকে মন দেয়। একসময় নীরবতা ভেঙে আপন মনে বলে,
_আমাদের বিষ বানানোর কোম্পানির গায়ে এখন প্রকৃতি ধ্বংসের নিন্দার কাঁটা। কোম্পানি বাঁচানোর সব চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার কাজ শেষ করে যে যার ঘরে ফেরার পালা।
_দেউলিয়া ঘোষণার মহোৎসবে শামিল হতে এমন জরুরি তলবে দেশ থেকে টেনে আনলে? নাকি তোমার মনে আর কোনো মতলব আছে? তুমি পেটে কথা রাখছ ফ্রাঙ্ক।
_তোমাকে নিয়ে লিটল ইন্ডিয়ায় ডিনার খাব। নাকি তোমার পছন্দ তাজমহল? আসলে একা একা ইন্ডিয়ান খাবার আর কোনোদিন খাওয়া হবে না বলে তোমাকে ঢাকা থেকে টেনে আনলাম।
ফ্রাঙ্কের কথাটা আমার বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু সরল বিশ্বাসের পথে আমার মনের ভেতর ভিন্ন কথার বাগড়া।
কেবলই মনে হচ্ছে 'এহ বাহ্য। গূঢ় কথা বলো ফ্রাঙ্ক।'
গ্রীষ্মের লম্বা দিনে সূর্য পাটে বসতে ভীষণ গড়িমসি করে। গ্রীষ্মের দিনগুলো বেশি লম্বা নাকি সবকিছুু ঘড়ির কাঁটার কারসাজি? যাক। এদেশের পাট যখন চুকে গেল তখন অতশত ভেবে লাভ কী? রাতের খাওয়া শেষে ফ্রাঙ্ক ঘুরপথে হোটেলের পথ ধরে। বর্নহাইম মিট্টে পেরিয়ে গুন্টার্সবার্গ পার্কের কোনায় এসে বলে,
_তুমি কি বেশি ক্লান্ত? এখনই হোটেলে ফিরতে চাও? নাহলে চল পার্কের বেঞ্চিতে একটু বসি।
_প্রকৃতির সঙ্গে মাখামাখি আমার ভালো লাগে না। ওখানে মানুষের কারিগরির চেয়ে ঈশ্বরের বাহাদুরি অনেক বড়। তার চেয়ে সায়েলের সারিসারি দোকানগুলোতে ঘুরতে আমার বেশি ভালো লাগবে। ওখানে থরেথরে সাজানো পণ্যের দাম কি শুধু টাকা আর প্রয়োজন দিয়ে বিচার করে ফেলা যায়? পণ্যের দাম আমার কাছে প্রচলিত বিশ্বাসের চেয়ে আরও বেশি কিছু। রাশি রাশি পণ্যের দিকে চেয়ে থেকে আমার মনে হয় মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা কি অসীম। সৃষ্টিশীলতার গুণ বিচারে আমার আস্থা মানুষের ওপরে। প্রকৃতির একঘেয়েমির পাশে মানুষ সত্যি নিত্য নতুন।
_তুমি থামবে। পণ্য তৈরির কারিগরি ঘিরে তোমার আদিখ্যেতা আমার মোটেও পছন্দ না। পেস্টিসাইড বানানোর বিদ্যা পেটে নিয়ে ভ্যানগগ মার্কা আবেগের বান ডাকিয়ে দেওয়া আমার অসহ্য ঠেকে।
_আমি ভ্যানগগের মতো সূর্যমুখী আঁকতে পারি না; কিন্তু গুণে-মানে সঠিক পেস্টিসাইড বানিয়ে জীবন্ত সূর্যমুখীর সতেজ বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে পারি।
ফ্রাঙ্কের চোখে রাগের আগুনের সঙ্গে আরও বাড়তি কোনো ভাষা খেলা করছে, যা অনুবাদ করার ভীষণ তাগিদ বোধ করছি।
গুন্টার্সবার্গ পার্কের গায়ে সবুজের ঢল। বেঞ্চের গা ঘেঁষে পেরেসকিয়া গল্গান্ডিফোলিয়ার গায়ে ঝুরিঝুরি বেগুনি ফুল। মালির চোখ এড়িয়ে ওর শক্ত গা বেয়ে ডেভিলস আই মুখ জাগাচ্ছে। চারপাশের কোনোকিছুর মধ্যে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছি না। সব ছাপিয়ে আমার মনের মধ্যে অজানা সন্দেহ গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। যিশুর শেষ ভোজের দৃশ্যটা মনের ভেতর বারবার জীবন্ত হয়ে উঠছে।
_ফ্রাঙ্ক আমি সিইওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। সম্ভব হলে আজ রাতেই। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করব না। দাঁড়াও দেখি ব্যাটাকে ফোন লাগাই।
_বৃদ্ধ এখন সব নেটওয়ার্কের ঊধর্ে্ব। কাল রাতে সে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছে। কোম্পানির প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে তার সিইও আর এপারে থেকে কী করবে। আমার কথা শোন, পেছনে ফেলে আসা দুই যুগ এবার মনের ভেতর কবর দিয়ে ফেল। এখন এ মুহূর্তে সব ভুলে বর্তমানের দিকে মন দাও।
এত বছরের সম্পর্ক এমন নিমেষে উধাও হয়ে গেল? নাকি শেষ পেরেক ঠোকার জন্য অনেক আগে থেকে ও কফিন গোছাচ্ছে!
আমার সন্দেহভরা দৃষ্টি পাশ কাটিয়ে ফ্রাঙ্ক ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে খানিক উদাস চেয়ে থেকে গলায় মরিয়া জোর ফুটিয়ে বলে,
_পেস্টিসাইডের নতুন কোম্পানি তোমাকে পাওয়ার জন্য আমাকে খুব করে ধরেছে। অভিজ্ঞ লোকের জন্য ওরা হাত খুলে টাকা ঢালতে পিছপা হবে না। ওদের ম্যানেজমেন্ট টিম যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসা চালাতে জানে। স্বাধীনভাবে কাজ করে আনন্দ পাবে।
গাছের ওপর ঘুঘুর একঘেয়ে ডাক থেমে গিয়ে চারপাশ এখন নিঝ্ঝুম। চারপাশে সন্ধ্যার আঁধার গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। পার্কেও এখানে ওখানে ঝোপের গায়ে জমাটবাঁধা ঝাপসা আঁধার। এখানে কখনও জোনাক জ্বলে না।
থোকা থোকা জোনাকের জ্বলা-নেভা দেখতে এবার আমাকে গাঁয়ে ফিরতে হবে।ডুবসাঁতার ও অন্যতর আলোর অপেরা0%গড় রেটিং:রেটিং :সিনেমায় কী দেখতে চাই আমরা? জীবন নাকি অন্য কিছু। আর যদি জীবন দেখতে চাই, সেটা তবে কার জীবন? অন্যের, না নিজের? যদি নিজের জীবন হয়! বিপত্তিটা শুরু হয় তখনই। কেননা আধপেট খেয়ে তৃপ্ত হওয়ার জীবনটাকে তো সারাটা জীবন কেবল লুকোতেই চেয়েছি আমরা? আর যদি কোনো সিনেমায় আমাদের, বিশেষত মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের বেঁচে থাকা, হাসি-কান্না, ঘৃণা-ভাব-ভালোবাসা এবং প্রতিটি দিনের সংগ্রাম ও নোংরামি উঠে আসে, তখন বিষয়টি নিশ্চয়ই আরামদায়ক কোনো অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে না?
সেই অস্বস্তিকর কাজটিই করেছেন নুরুল আলম আতিক, তার ডুবসাঁতার সিনেমায়। তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন খুব সাধারণের জীবন; আর এমন একটি পরিবারের মধ্য দিয়ে গল্পটি বলেছেন, যে পরিবারে প্রতিদিন সকাল মানেই, আলুভাজির সঙ্গে পরোটা এবং এক কাপ লাল চা। আর মায়ের সঙ্গে সময়ের তাড়া খেয়ে ফেরা এক উন্মুল তরুণের অশ্লীল ঝগড়া। শুধু তা-ই নয়, সেই পরিবারে আরও আছেন, স্বামীর ঘর করতে না পারা এক মেয়ে রেণু। আর আছেন জন্মান্ধ এক বড় ভাই। জানা যায়, পরিবারের বাবাটি অনেক আগেই এই সংসারের জোয়াল বইতে বইতে এ পৃথিবী ছেড়েছেন। ফলে সংসারটি টেনে নেওয়ার পুরো দায়িত্বটি যেন রেণুর। আর রেণুও, এ সমাজের যে কোনো রেণুর মতোই, বিষয়টি মেনেই নিয়েছে যেন। ফলে সিনেমার প্রথমে তাকে দেখি আমরা আবেগহীন এক সাধারণ কর্মজীবী নারী হিসেবেই, যে ৫ টাকা বাঁচানোর জন্য, তরকারিওয়ালার সঙ্গে দুটি বেশি কথা খরচ করতেও রাজি থাকে। আর এ কারণেই রেণুুুকে আমরা কল্পনা করি, তার শৈশবে ভুল করে রেললাইনের ওপর উঠে যাওয়া হাঁসটির ভূমিকায়! এবং আমরা বিশ্বাস করি, পরিবারের সব আবদার মেটানোর পর, যে রেণু থাকে, সে একটা হাঁসই; মানুষ নয়।
আর আমাদের কাছে হাঁসে রূপান্তরিত হওয়া রেণু, বহুবিধ ঝড়-জল ও সংকটের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে বারা বার আশ্রয় খোঁজে অন্ধ বড় ভাই ও মহান শৈশবের কাছে। যেখানে রেণু মুহূর্তেই উতলা হয়ে হারায়, মুখ গুঁজে দেয় আর লাল-নীল স্মৃতির মধ্যে একটুক্ষণের জন্য হলেও পায় আশ্রয়। ফলে আমরা
দেখি, শৈশবের মতোই, অন্ধ ভাইয়ের সঙ্গেও অদ্ভুত একটা সম্পর্ক তৈরি হয় তার, এ জগতের তীব্র মায়া ও ভালোবাসার সুগন্ধ ছড়িয়ে। যেখানে দেখি অন্ধ ভাইটির শেভ করে দেওয়াসহ, চুল আঁচড়ে দেওয়ার বিষয়গুলোই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এ সিনেমায়। পাশাপাশি অজস্র নাই নাই ও প্রবল অক্ষমতার মধ্যেও মা এক ভাত-চোরের জন্য অপেক্ষা করেন মমতার ডালি ছড়িয়ে। আর এসব দৃশ্য দেখে বুঝতে পারি, এ সিনেমায় নুরুল আলম আতিক এমনি এমনি ছেড়ে দেবেন না জীবনটাকে। একে ভাঙবেন পুরোপুরি, আবার গড়বেনও।
তাই ঘটেও বটে। ফলে দেখি হঠাৎ করেই সমাজ ও সংসারকে থোড়াই কেয়ার করা ইমরানের আবির্ভাব ঘটে, রেণুর জীবনে। আর এক্ষণে আমরা বুঝতে পারি, খেলাটা জটিল হয়ে যাবে। এত সরল থাকবে না। দাবার বোর্ডে মুখোমুখি দুটি ঘোড়াও মাঠে নামবে এবার। একটি ঘোড়ার নাম হবে সমাজ-সংসার। অন্য ঘোড়াটির নাম হবে প্রেম। এবং তাদের মধ্যে শুরু হবে তীব্র অন্তর্ঘাত। তা শুরুও হয়। ফলে দেখি, যে রেণু ডুবে ছিল একটি পরিবারের আশ্রয় হয়ে ওটার স্বপ্নে। যে চেয়েছিল, দুই বছরের ভেতর পাল্টে দিতে পরিবারের চেহারাটি, সে নাই হয়ে গেছে। সে আর ডিভোর্সি ও রঙহীন কোনো সাদা ও কালোয় গড়া রেণুু নয়। এ রেণুু উড়তে চায়। এ রেণুু অদ্ভুত আনন্দে মাতাল, যে তার মানসিক ও শারীরিক প্রয়োজনে সাড়া দিতে জানে। বুঝতে পারি, এই এক চরম বিষয় আমাদের মধ্যবিত্তের জীবনে, যেখানে ব্যক্তির কোনো জীবন নেই। যেখানে ব্যক্তি মানেই সমষ্টির অংশ। ফলে সমষ্টির প্রয়োজনেই সাড়া দিতে হয় তাকে।
কিন্তু রেণু এই সমষ্টির অংশ হয়েও যখন নিজের ব্যক্তিটিকে আর ঠকাতে চায় না, তখনই টালমাটাল হয়ে ওঠে একটি পরিবার। ফলে বিবিধ সংকট একটি পরিবারকে চারদিক থেকে ঝাপটে ধরে। আর সংকটের আবর্তে পড়ে যাওয়া মানুষগুলোর নিরুপায় মুখ ভেসে ওঠে পর্দায়। দেখি অন্ধ ভাইটি অপমানিত হয়, পাড়ার মাস্তানের কাছে। এবং রাতে বাড়ি ফেরা নিয়ে ছোট ভাইটিও রেণুকে আক্রমণ করে বসে। তবে এই সংকটেরও সমাপ্তি আসে, ইমরানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে দেখা যায়। এবার রেণুর সামনে এসে দাঁড়ায়, ভ্রূণের পিতৃপরিচয়ের প্রশ্ন। এমন সংকটের ভেতরে থেকেও মেয়েটি যেন উঠে দাঁড়াতে চায়। নিজের জেগে ওঠার মুহূর্তের চিহ্নটুকুকে পৃথিবীতে টেনে আনতে চায়, অসীম সাহসে। অথচ রেণুর সর্বশেষ আশ্রয়টুকু, মানে তার রক্তে তিলে তিলে বড় হতে থাকা ভ্রূণটাও নষ্ট হয়ে যায় একদিন। আর সিনেমার এ পর্যায়ে পরিচয়হীন একটি ভ্রূণের মৃত্যুতে, আমরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি, একটু নিষ্কৃতি পাই।
আর নিষ্কৃতির পর, রেণু তখন আবারও যে কোনো রেণু। সাদা ও কালোয় গড়া নিয়তিতাড়িত এক মানুষ কেবল। যার কোনো স্বপ্ন নেই। আশ্রয় নেই। কোনো আশ্রয় ও স্বপ্ন না থাকলেও কেবল থাকে তার প্রিয়তম শৈশব ও অতিচেনা এক দীর্ঘকায় রেললাইন; আর এ কারণেই, শেষ দৃশ্যে রেণু তার খুব পরিচিত রেললাইনে এসে দাঁড়ায় আবার। খুব পরাজিত এক মানুষ যেন। যে জানে পথ যেহেতু আছে, তখন গন্তব্য একটা থাকবেই। কিন্তু সেই গন্তব্যও যেন পরিষ্কার নয়; কুয়াশায় ঘেরা। ফলে অজস্র মানুষের মতো, গন্তব্য না জেনেই, আবারও একটি নতুন দিনের শুরু হয় রেণুর। যে দিনে কেবল বয়ে যাওয়াই হয়, কিন্তু গন্তব্য মেলে না মানুষের। হ্যাঁ, এভাবেই আমার-আপনার কোনো কিছুই না পাওয়ার জীবনে, বেদম হাহাকার ছড়িয়ে দিয়ে, দুর্ভাগ্যপীড়িত মধ্যবিত্তের জীবনটাকে নির্মোহভাবে তুলে ধরে, শেষ হয়ে যায় সিনেমাটা। আর আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে অন্ধ বড় ভাইটিকে, যে ফুল ভেবে সাপের লেজ ধরে টান মেরেছিল। আর যে ব্রেইলে ব্রেইলে ডিরেক্টরের হাত ধরে লিখে যাচ্ছিল পুরোটা সিনেমা, যার নাম আলোর অপেরা? তবে সিনেমাটা দেখার পর মনে হলো, অন্ধ ভাই ও বোনের সম্পর্কটি আরও বিস্তৃতি পেলে ভালো লাগত। ভাবি, পুরো সিনেমাটাই যদি এই সম্পর্ক বিনির্মাণ করেই শেষ হতো, খারাপ হতো না। তবে তিনি্নর অভিনীত চরিত্রটিই একমাত্র দুর্বল ও অপ্রয়োজনীয় চরিত্র বলে মনে হয়েছে পুরো সিনেমায়। এ চরিত্রটি 'ডুবসাঁতার'-এ না থাকলেও হতো। তবে দৃশ্য নির্মাণে অথবা পরিস্থিতি তৈরিতে যে নুরুল আলম আতিক ঈর্ষণীয় ক্ষমতার অধিকারী তা আবারও মানতে হলো, মস্তক নত করেই। বিশেষ করে, অন্ধ ভাইয়ের সঙ্গে, দাবা খেলায় মত্ত থাকা অবস্থায়, রেণুর খুব সাধারণ মা যখন ইমরানের পাশে এসে বসেন। জিজ্ঞেস করেন, ইমরান কী করে। বেতনের টাকায় চলে কি-না? পরিবারে কে কে আছে? শুধু তাই নয়, আরও জিজ্ঞেস করে, এত সুন্দর চেহারাটা চুল দিয়া ঢাইকা রাখ ক্যান? ওই মুহূর্তে একজন চিরায়ত মায়ের যে অবাক আকুতি এবং সঙ্গে উন্নাসিক উচ্চ বংশীয় এক ছেলের কাছে সেই আকুতি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর যে বিষাদ মুহূর্ত তৈরি করেছেন নুরুল আলম আতিক, তা অসাধারণ। শুধু তা-ই নয়, চলন্ত রেলের বগির তলে পড়ে যাওয়া হাঁসটির বেঁচে থাকার জন্য যে সংগ্রাম, আর সেই দৃশ্যের যে পোয়েটিক ক্ষমতা, তা আমাদের সংগ্রামমুখর জীবনে অনুপ্রেরণার কারণ হয়েই থাকবে বোধকরি। সিনেমাটা দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, কবিতাকে যদি সর্বোচ্চ ইমেজের জায়গা বলে ধরে নেওয়া হয়। তাহলে ডুবসাঁতারের প্রতিটি দৃশ্য, অজস্র কবিতাকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ সিনেমায় নুরুল আলম আতিকের গল্প বলার ভঙ্গিটাও অদ্ভুত পোয়েটিক। একটি দৃশ্য থেকে আরেকটি দৃশ্যে যেতে যেতে মনে হয়েছে কেবল যেন, কবিতার শরীর হতে, একেকটি ইমেজ খসে পড়ছে চোখের সামনে। আর হ্যাঁ, এই ফিল্মটি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, এটিও আসলে পপকর্ন খেতে খেতে দেখার মতো সিনেমা নয় মোটেও। এমন কী এর অন্তর্গত বিষাদ, জটিলতা, আবেগ ও অনুভবকে বুঝতে হলে, পূর্ণ মনোযোগ নিয়েই এই সিনেমার কাছে যেতে হবে আপনাকে।
এভাবেই, নুরুল আলম আতিকের ক্যারিশমায় যে 'ডুবসাঁতার' রচিত এই দেশে, তা অনেকাংশেই নতুন এক সিনেমাই হয়ে ওঠে। এবং বাংলাদেশি সিনেমার জন্য অন্যতর এক আলোময় যাত্রার কথাই
ইঙ্গিত করে যেন। তা হতে পারে জীবনের অনুভূতি প্রকাশের মুন্সিয়ানায়। অথবা জীবনের বিচিত্র বিষয় উপস্থাপনের সাহসে। কিংবা গল্প বলার ভঙ্গিতে। ঠাস বুননে। অথবা রাশেদ জামান ও তার ক্যামেরার অস্বাধারণ কাজে।
বিজয় আহমেদবৃহদেশ্বরা মন্দির0%গড় রেটিং:রেটিং :সুপ্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের একাদশ শতকে নির্মিত তামিলনাড়ূর থানজাভারে অবস্থিত বিস্ময়কর ও নান্দনিক বৃহদেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। তামিলনাড়ূর এ মন্দিরটি পৃথিবীর প্রথম মন্দির, যা পূর্ণাঙ্গ গ্রানাইট পাথরে নির্মিত ও সজ্জিত। এর পৃষ্ঠপোষক ও রূপকার রাজারাজাকোলা (১) এর আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রানাইট পাথরের অনবদ্য গাঁথুনিতে। ভারতীয় স্থাপত্যকলার গৌরবময় ঐতিহ্যকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট 'গ্রেট লিভিং কোলা টেম্পলস' নামে মর্যাদা প্রদান করেছে।
এই মন্দির ভারতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকাগুলোর অন্যতম। ষোড়শ শতকে এই মন্দিরের চতুর্দিকে দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টন করা হয় । মন্দিরের ২১৬ ফুট (৬৬ মিটার) উচ্চতাবিশিষ্ট ভিমানা টাওয়ার পৃথিবীতে অবস্থিত সব মন্দিরের মধ্যে অন্যতম। এটা সবাই বিশ্বাস করেন যে, মন্দিরের সবচেয়ে উপরে স্থাপিত কালাস বা চিকারাম নামে পবিত্র পাথর এটাকে কোনোদিকে হেলতে দেয় না। মন্দিরের প্রবেশপথে নন্দি নামে একটি পবিত্র ষাঁড়ের মূর্তি আছে, যার দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট এবং উচ্চতা ১৩ ফুট। মন্দিরের পুরো এলাকা শক্ত গ্রানাইট পাথরের আবরণ দ্বারা নির্মিত। এ ধরনের গ্রানাইট পাথরের মন্দির এসব এলাকায় এখনও ঠিকে আছে। থানজাভারে অবস্থিত ১০১০ এডিতে নির্মিত বৃহদেশ্বরা মন্দির বড় মন্দির নামেও ব্যাপকভাবে পরিচিত, যা প্রায় এক হাজার বছর অতিক্রম করেছে। পুরো মন্দিরটি ১,৩০,০০০ টন গ্রানাইট পাথরে তৈরি। ৬০ মিটার উঁচু ভিমানা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু। এই মন্দিরের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো এর গপুরামের ছায়া কখনও মাটিতে পড়ে না। কিন্ত এই কল্পকথা পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ইতিহাস : তামিল কোলা প্রকল্পের আওতায় ১০০২ (সিই)-তে তামিল রাজা আরুলমজিহভারমান (রাজারাজাকোলা নামে বেশি পরিচিত) এর ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ করেন। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা রাজারাজাকোলা স্থপতি কুনজা মালান রাজারাজাকে এই মন্দির নির্মাণের আদেশ দেন। কোলা বংশের মর্যাদা ও আভিজাত্য হলো এর শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। এই মন্দিরটি তৎকালীন কোলা সাম্রাজ্যের শক্তি ও নান্দনিকতাকে ফুটিয়ে তুলেছে। এখানে প্রতিনিয়ত দেবতাকে (শিব) পূজা দেওয়া হতো এবং রাজা প্রতিনিয়ত এসব উৎসবের প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতেন। মন্দিরটিতে ছয় শতাধিক সেবক কাজ করতেন। ব্রাহ্মণ ছাড়াও এখানে রেকর্ডকিপার, বাদক, বুদ্ধিজীবী, পাচক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হতো। প্রার্থনার দিন মন্দির চত্বরে অনেকটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। উৎসব এবং পূজার দিন ফুল বিক্রেতা, দুধওয়ালা, তেল বিক্রেতা, ঘি ব্যবসায়ী প্রভৃতি শ্রেণী ও পেশার মানুষ তাদের পণ্য বিক্রি করত। একদল নৃত্যশিল্পী পূজা ও উৎসবের সময় ভরতনাট্যম নাচ প্রদর্শন করত। বর্তমানে প্রতি বছর মন্দির চত্বরে ভরতনাট্যম নাচের আয়োজন করা হয়।
মন্দির এলাকা :দক্ষিণ ভারতের তামিল সভ্যতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো দ্রাভিদা গোত্রের এই মন্দিরটি, যা কোলা সাম্রাজ্যের আদর্শ ও কৃষ্টিকে লালন ও ধারণ করে। মন্দিরের স্থাপত্য, ভাস্কর্য, রং ও ব্রোঞ্জ কাস্টিং এর অনন্য বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলেছে। মন্দির চত্বর নদী এলাকায় অবস্থিত এবং এর চতুর্দিকে শক্ত বেষ্টনী দ্বারা পরিবেষ্টিত। মন্দিরে অবস্থিত পাঁচতলাবিশিষ্ট গপুরাম দিয়ে প্রবেশ করা যায় অথবা চতুর্কোনাকৃতির ছোট গপুরাম দিয়েও মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায়। মন্দিরের প্রধান সিকারার উচ্চতা প্রায় ৬৩ মিটার, যার সঙ্গে ১৬ প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট কক্ষ রয়েছে এবং এই কক্ষগুলো প্রধান মন্দিরের প্রতিনিধিত্ব করে। সংযুক্ত কলামগুলো প্রত্যেকটি সিকারার সঙ্গে ছন্দময় স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
যাতায়াতের মাধ্যম : থানজিভারে সড়ক, রেল ও আকাশপথে ভ্রমণ করা যায়। চেন্নাই, ট্রিচি, কমারবাকোনাম, পুডুকোট্টাই, পাটুকোট্টাই, টিরুনেভেলি, কারুও, নাগাপট্টম, কোইমবাটোরিসহ অনেক নগরী থেকে এ শহরে আসার জন্য রাজ্য সরকার বাস, ট্রেন ও উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করেছে। জাতীয় মহাসড়ক চেন্নাইকে চিদাম্বরম, মায়াভরম কুম্বাকোরম, টানজোরি এবং নাগাপট্টম প্রভৃতি শহরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। বিদেশি পর্যটক যারা টানজাভোর বা এর পার্শ্ববর্তী শহরে ভ্রমণ করতে আগ্রহী তারা এই মহাসড়ক ব্যবহার করে সহজেই এখানে আসতে পারেন। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক বাস এখানে চলাচল করে। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে চেন্নাই থেকে ট্রিচি, টিরিনেলভেলি, মাডুরিয়া, নাগর প্রভৃতি শহরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। থানজাভার স্টেশন এখানে টানজোর জংশন নামে পরিচিত।
নিকটবর্তী বিমানবন্দরের নাম টিরুচিরাপল্লী বিমানবন্দর, যেখান থেকে ট্রিচি ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার এখানে ভরতনাট্যম নাচের আয়োজন করে। বিখ্যাত নাট্যশিল্পী পদ্মা সুব্রমোনিয়ামের অতুলনীয় নৃত্যজাদুতে স্থানীয় ও আগত অতিথিরা কিছু সময়ের জন্য যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান। এই অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে ভরতনাট্যম শিল্পী সমিতি ও থানজিভার ভরতনাট্যম ট্রাস্টের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। মন্দিরের হাজার শতবার্ষিকীতে দিলিল্গ, মুম্বাই, পুনে, তামিলনাড়ূ, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরালাসহ যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার নৃত্যশিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। নৃত্যশিল্পীরা শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাট নৃত্যজাদুতে মাতিয়ে রাখেন দিনরাত। প্রতি বছর ২৬ সেপ্টেম্বর ছোট এই শহরটি যেন এক সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় পরিণত হয়। ক্যাবিনেট মন্ত্রী এর হাজার শতবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত করেন। ভারত সরকার এর হাজার শতবার্ষিকী উপলক্ষে পাঁচ টাকার ধাতব মুদ্রা বাজারে ছাড়েন। তামিলনাড়ূর মুখ্যমন্ত্রী বৃহদেশ্বরা মন্দিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের সম্মানে এম করুণানিধি ধানের নাম পরিবর্তন করে রাজারাজাকোলা (১) নামে বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দেন। এতসব রহস্য আর বিস্ময়জাগানিয়া মন্দিরটি দেখার জন্য আমার ভীষণ লোভ হচ্ছে। পাঠক, যাবেন নাকি তামিলনাড়ূর এই মন্দিরে?
এম এম আলীকিশোরগঞ্জের মেয়েলী গীত0%গড় রেটিং:রেটিং :বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা ভাষার একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য এবং ঋদ্ধ শাখার নাম গীতিকবিতা। আমাদের গীতিকাররা অনেক আগ থেকেই নিজস্ব ঢঙে এ ধারায় তাদের নিজ নিজ সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছেন। মুদ্রণশিল্পে পশ্চিমা দুনিয়া থেকে আমরা পিছিয়ে থাকায় আমাদের প্রাচীন অনেক গীতিকবিতা এবং অন্যান্য সাহিত্যকর্মের লিখিত নজির নেই। লোকমুখে যেসব রচনা আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারে থেকে গেছে তার মুদ্রণ নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে নাহার কামাল আহমদের সংগ্রহ এবং সম্পাদনায় প্রকাশিত 'কিশোরগঞ্জের মেয়েলী গীত' গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ। বইটির ভূমিকায় ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, 'সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মানবিক ধারার এ গীতগুলো দেশের সব অঞ্চল থেকে আজও পূর্ণভাবে সংগৃহীত হয় নাই।' প্রকৃতপক্ষেই আমাদের বিচিত্র ধারার লোকসাহিত্য আজও লোকের মুখে মুখে যতটা আছে, লিখিত আকারে তার বেশিরভাগই অনুপস্থিত। নদী তীরবর্তী হওয়ায় কিশোরগঞ্জ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলের গীতিকাগুলো বহির্বিশ্বেও পরিচিত। নাহার কামাল আহমদ তার এ গ্রন্থে ৯৪টি মেয়েলী গীত তুলে ধরেছেন। কিশোরগঞ্জের মৌলিক ভাষাভঙ্গি ঠিক রেখেই এ সংকলনে গীতগুলো স্থান পেয়েছে। সম্পাদক গীতগুলোর নিচে সংগ্রহস্থল এবং ঠিকানা উল্লেখ করে তার সাহিত্যিক সততার পরিচয় দিয়েছেন।
উৎসব উপলক্ষ এবং বিভিন্ন পার্বণে গ্রামবাংলার অনেক অঞ্চল মেয়েলি গানে মুখরিত হতো। সহজাত সাহিত্য প্রতিভায় মুখে মুখে রচিত এই গীতগুলো দীর্ঘকাল ধরে অন্তপুরের মেয়েদের মুখে মুখে টিকে রয়েছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত এসব গানে তৎকালীন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সমাজে নারীর অবস্থান ইত্যাদি ফুটে উঠেছে। ফলে এই গীতগুলোর নৃতাত্তি্বক গুরুত্বও কম নয়। স্যাটেলাইট আর শহুরে সাংস্কৃতির দাপটে আমাদের এসব প্রাচীন ঐতিহ্য ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। লোকসাহিত্যের এ ধারাকে যথার্থ পরিচর্যা না করলে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নাহার কামাল আহমদ তার সংকলনটিতে টিকা ভাষ্য সংযুক্ত করায় সব অঞ্চলের পাঠকের জন্যই গ্রন্থটি সহজপাঠ্য হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
কিশোরগঞ্জের মেয়েলী গীত; সংগ্রাহক ও সম্পাদক : নাহার কামাল আহমদ ; মূল্য : ১৪০ টাকাশালুক0%গড় রেটিং:রেটিং :'নব্বই দশকের ৪২ জন কবির কবিতা নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে এ সংখ্যাটির। এ তালিকা দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো বাংলাদেশের কবিরা, অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের কবিরা। একটি দশকে ৪২ জন প্রধান কবি সত্যিই অসামান্য পাওয়া। তবে আমার ধারণা নব্বই দশকের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ কবিরা এখানে বাদ পড়েছেন
সম্প্রতি সাহিত্য ও চিন্তা শিল্পের ছোট পত্রিকা 'শালুক' বাংলা ভাষার নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবিদের কবিতা নিয়ে বের করেছে বিশেষ সংখ্যা। 'নব্বই দশকের ৪২ জন কবির কবিতা নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে এ সংখ্যাটির। এ তালিকা দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো বাংলাদেশের কবিরা, অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের কবিরা। একটি দশকে ৪২ জন প্রধান কবি সত্যিই অসামান্য পাওয়া। তবে আমার ধারণা নব্বই দশকের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ কবিরা এখানে বাদ পড়েছেন। স্থান পেয়েছেন একদম কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অযোগ্য কেউ কেউ। অবশ্য কোনো সংকলনই শেষ পর্যন্ত পূর্ণ হয়ে ওঠে না। কিছু না কিছু সমস্যা সব সংকলনেই বিদ্যমান থাকে। ফলে একটি পত্রিকার সম্পাদক যখন 'প্রধান' অভিধাটি তার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যুক্ত করেন সে ক্ষেত্রে অনেক দায় তার থেকে যায় বলেই আমি মনে করি। এই সংখ্যায় বাংলাদেশের ২১ জন কবিকে নিয়ে লিখেছেন সাহিত্য সমালোচক ও কবি মাসুদুজ্জামান। তার প্রবন্ধে তিনি নব্বইয়ের কবিদের প্রবণতা, ভাবনা, তাদের ভাষাভঙ্গি এবং আঙ্গিক নিয়ে অর্থবহ আলোচনা করেছেন। বাংলা কবিতার ক্রমপ্রবহমান ধারার উল্লেখ করে সাম্প্রতিক কবিদের রচনার সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন তাদের রচনাকে। তেমনি চিত্রকল্প এবং ভাবনার পরিবর্তনও চিহ্নিত করেছেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবিদের কবিতা নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন কামরুল ইসলাম। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের অন্য অঞ্চলের কবিদের কবিতার সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর জন্য 'শালুকে'র এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে বাংলাদেশের কবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি ঘটেছে, অন্য ক্ষেত্রেও তেমনটি হলে বিষয়টি চিন্তার। বাংলাদেশ এবং ভারতের বেশকিছু জায়গার ভাষা হিসেবে বাংলা চালু থাকলেও এসব অঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিদ্যমান। অন্য সংস্কৃতি এবং ভাষার সংগঠনের সঙ্গে পরিচয়ের ভূমিকা হিসেবে কামরুল ইসলামের প্রবন্ধটি উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে 'শালুকে'র বর্তমান আলোচিত সংখ্যায় প্রচুর কবিতার পাশাপাশি বিশ্লেষণী কয়েকটি প্রবন্ধও মুদ্রিত হয়েছে। ওবায়েদ আকাশ ও শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এ সংখ্যাটিতে যদি কবি নির্বাচনে সম্পাদকরা একটু যত্নবান হতেন তাহলে এটি আরও সুখপাঠ্য ও সমৃদ্ধ হতো বলেই আমি মনে করি।
শালুক, সম্পাদক : ওবায়েদ আকাশ, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মূল্য : ১০০ টাকা।
মেহেদি হাসানবাঙালি মধ্যবিত্তের বর্জনপ্রীতি0%গড় রেটিং:রেটিং :সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
কিন্তু ওই যে বর্জন তার ফলে সংকোচন ঘটেছে কেবল সাহিত্যের নয়, সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক রুচিরও। একদিকে শুচিবায়ুগ্রস্ততা অন্যদিকে সংকীর্ণতা ঢুকে পড়েছে। পরিণামে আমরা খর্ব হয়েছি এবং এখনও হচ্ছি। বিশ্বায়ন আমাদের নত করছে, এদিকে ভেতরে ভেতরে কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত আমরা নিজেদের খাটো করছি। বাঙালি তার যেটুকু উচ্চতা ছিল তাও রক্ষা করতে পারছে না
বর্জনের ব্যাপারে বাঙালি মধ্যবিত্ত বরাবরই সিদ্ধহস্ত। যেমন ধরা যাক, সমুদ্রের ব্যাপারটা। সমুদ্রকে সে বর্জন করেছে, ফলে নিজেই খর্ব হয়ে গেছে। এখনও সে বন্দরের গুরুত্ব বুঝতে চায় না, যে জন্য আশঙ্কা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর চলে যাবে বিদেশিদের হাতে। ভাষার ক্ষেত্রে তার যে বর্জনবাতিক সেটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এ তার সাধারণ ও প্রসিদ্ধ বর্জনবাদীতারই অংশ। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা পরস্পর ভাষা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছেন। এক পক্ষের ইচ্ছা ছিল ভাষাকে অনুস্বার-বিসর্গ দিয়ে ভরপুর করবে, অন্যপক্ষ আকাঙ্ক্ষা করেছে তাকে আরবি-ফার্সি শব্দ দিয়ে সাজিয়ে তুলবে; ফলত উভয়পক্ষের হাতেই বাংলাভাষা নিষ্পিষ্ট হয়েছে। সে সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাও পুষ্ট হয়েছে এবং পরিণামে অবিভক্ত বঙ্গ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। মস্তবড় সেই কাটাছাঁটায় ব্যক্তিগতভাবে লাভ হয়েছে কারও কারও, মধ্যবিত্তের একাংশেরই মূলত, কিন্তু খুব বড় ক্ষতি হয়ে গেছে বাংলার অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং প্রকৃতির। এমনকি প্রকৃতিরও।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নজরুলের 'খুন' শব্দের অত্যন্ত সঙ্গত সাহিত্যিক ব্যবহারকে মেনে নিতে পারেননি। ওই রকম আপত্তি নিয়ে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের মনে ক্ষোভ ও অভিমান জমে উঠেছিল; আর তারই সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কিছু তল্পিবাহক সাতচলি্লশের পর বর্ণমালা সংস্কার তো বটেই, ভাষা সংস্কারেও উদ্যোগী হয়েছিল। তারা রবীন্দ্রনাথকে ছেঁটে ফেলবে, নজরুলকে সংশোধিত করবে, শ্মশানকে করবে গোরস্তান, প্রেমকে করবে মহব্বত_ এ ধরনের অভিসন্ধিতে লিপ্ত ছিল। সফল হয়নি। কেননা মানুষ অতটা বেকুব এবং খর্ব হতে প্রস্তুত ছিল না।
বর্জনের ব্যাপারটা ঐতিহ্যের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সাহিত্য ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের ঐতিহ্য মুসলিম সাহিত্য সাধনার ধারাটিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সেটাও ওই একই চেষ্টা, কেটেছেঁটে খাটো করার। শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তও কম যায়নি। যেমন_ তাদের একটি প্রভাবশালী অংশ নজরুল ইসলামকে কবি বলেই মানতে চায়নি। বলেছে এর গলা অতিশয় চড়া, এ লোক বড় বেশি উত্তেজিত। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নজরুলকে কবি বলেই মানতেন না। বুদ্ধদেব বসু মানতেন, তবু অতিউচ্চে স্থান দিতেন না। অথচ সত্য তো এই যে, বাংলা কবিতার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের পর যার স্থান তিনি ওই নজরুলই। আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন গ্রন্থগুলোতে দেখা যাবে, কোনো কোনোটিতে নজরুলের স্থান খুবই সঙ্কুচিত, কোথাওবা তিনি একেবারেই অনুপস্থিতি। এই বর্জনে নজরুলের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, কিন্তু খর্ব হয়ে গেছে বাঙালির সাহিত্যরুচি এবং প্রশ্রয় পেয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। উল্লেখ্য, জীবনানন্দ দাশ যে তার সময়ের তথাকথিত আধুনিক কবিদের ছাড়িয়ে উঠেছিলেন নিজের প্রতিভার মৌলিকতায় তার একটি প্রমাণ এই যে, নজরুলকে তিনি গুরুত্ব দিতেন এবং কাব্যজীবনের সূচনায় নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত হতে অসম্মত হননি।
কিন্তু ওই যে বর্জন তার ফলে সংকোচন ঘটেছে কেবল সাহিত্যের নয়, সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক রুচিরও। একদিকে শুচিবায়ুগ্রস্ততা অন্যদিকে সংকীর্ণতা ঢুকে পড়েছে। পরিণামে আমরা খর্ব হয়েছি এবং এখনও হচ্ছি। বিশ্বায়ন আমাদের নত করছে, এদিকে ভেতরে ভেতরে কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত আমরা নিজেদের খাটো করছি। বাঙালি তার যেটুকু উচ্চতা ছিল তাও রক্ষা করতে পারছে না। একাত্তরের যুদ্ধ আমাদের বড় করবে বলে ভরসা করা গিয়েছিল, কিন্তু বড় হতে পারলাম না। না পারার কারণ নানাবিধ ভ্রান্তি, অপচয় এবং নেতৃত্বের ব্যর্থতা। এসব সত্যই বাংলা বানানের ওপর অকারণ হস্তক্ষেপের মধ্যে প্রতিফলিত। ভ্রান্তি ও অপচয় তো রয়েছেই, আছে নেতৃত্বের ব্যর্থতাও। রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, প্রায় সব ক্ষেতেই বলা যায়, যারা নেতৃত্ব পেয়েছেন অথবা জবরদখল করেছেন তারা মোটেই যোগ্য নন; কেবল অযোগ্য হলে তবু কথা ছিল, এরা আবার স্বেচ্ছাচারীও, নিজেরা যা বোঝেন সেটাই সর্বোত্তম জ্ঞান করেন এবং সেটাকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। বানান সংস্কারকরাও ওই একই কাজ করছেন।http://www.samakal.com.bd/details.php?news=29&view=archiev&y=2010&m=11&d=14&action=main&option=all&menu_type=tabloid&pub_no=515&type=
তিতাস একটি নদীর নাম (চলচ্চিত্র)
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
তিতাস একটি নদীর নাম
তিতাস একটি নদীর নাম ডিভিডি কভারপরিচালক ঋত্বিক ঘটক প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান কাহিনী ঋত্বিক ঘটক (চিত্রনাট্য)
অদ্বৈত মল্লবর্মণ(মূল কাহিনী)শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় গোলাম মুস্তাফা, কাবরী চৌধুরী, রোজী, প্রবীর মিত্র
সঙ্গীত পরিচালক উস্তাদ বাহাদুর খান চিত্র গ্রহণ বেবী ইসলাম সম্পাদনা বাসীর হুসেন মুক্তির
তারিখ১৯৭৩ দৈর্ঘ্য ১৫৯ মিনিট দেশ বাংলাদেশ
ভারতভাষা বাংলা IMDb profile তিতাস একটি নদীর নাম ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত চলচ্চিত্র। তিতাস একটি নদীর নাম অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছে।
ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের এক জরীপে এটি সবার সেরা ১০টি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকার মধ্যে শীর্ষস্থান লাভ করেছে। [১]
সূচিপত্র
[আড়ালে রাখো][সম্পাদনা]কাহিনী সংক্ষেপ
[সম্পাদনা]শ্রেষ্ঠাংশে
- ফকরুল হাসান বৈরাগী - নিবারন
- নারায়ন চক্রবর্তী - মোড়ল
- বনানী চৌধুরী - মোড়লের গিন্নী
- কবরী চৌধুরী - রাজার ঝী
- চৈতান্ন দাস -
- ঋত্বিক ঘটক - টিলকচান্দ
- শফিকুল ইসলাম - অনন্ত
- সিরাজুল ইসলাম - মেগান সরদার
- রওশন জামল - মা
- এম এ খায়ের - বাসন্তির বাবা
- প্রবির মিত্র - কিশোর
- গোলাম মুস্তাফা - রামপ্রাসাদ (কাদের মিয়া)
- সুফিয়া রুস্তাম - উদাবতারা
- রোজী সামাদ - বাসন্তী
- রানী সরকার - মুংলি
[সম্পাদনা]সম্মাননা
[সম্পাদনা]সংগীত
তিতাস একটি নদীর নাম ছবির সংগীত পরিচালনা করেন উস্তাদ বাহাদুর খান।
[সম্পাদনা]গানের তালিকা
[সম্পাদনা]আরও দেখুন
[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
- ↑ Top 10 Bangladeshi Films, ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট।
[আড়াল করো]বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত · ঋত্বিক ঘটক · গৌতম ঘোষ · ঋতুপর্ণ ঘোষ · তরুণ মজুমদার · হৃষিকেশ মুখার্জী · সত্যজিৎ রায় · বিমল রায় · অপর্ণা সেন · হীরালাল সেন · মৃণাল সেন · তপন সিংহ · আরো…অভিনেতা ইতিহাস জনপ্রিয় সিনেমা ৩৬ চৌরিঙ্গী লেন · অপরাজিত · অপুর সংসার · বিল্বমঙ্গল · চারুলতা · চোখের বালি(চলচ্চিত্র) · দেনা পাওনা · দীপ জেলে যাই · ঘরে বাইরে(চলচ্চিত্র) · হাসুলী বাঁকের উপকথা · হারানো সুর · জীবন থেকে নেয়া · মাটির ময়না ·মেঘে ঢাকা তারা · নীল আকাশের নীচে · পথের পাঁচালী · সপ্তপদী(চলচ্চিত্র) · তাহাদের কথা · তিতলি · উনিশে এপ্রিল · আরো……২০০৮-এর চলচ্চিত্র
No comments:
Post a Comment